বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | বাস্তব জীবনের কষ্টের স্ট্যাটাস

 বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের গল্প

দয়াকরে সম্পূর্ণ গল্প পড়ুন তাহলে বুঝে আসবে।

ছেলেঃ আই লাভ ইউ ইরি।

ইরিঃ থাপ্পড় চিনেন?

- চিনি তো

- খাবেন?

- কে দেবে?

- আমি।

- দেরী করছো কেনো? এক্ষুনি দাও।

- লজ্জা করেনা আপনার?

- আমি তো প্যান্ট পরে আছি।

- আপনাকে যে কি করি?

- বিয়ে করো।

-আসলেই একটা থাপ্পড় দেয়া উচিত আপনাকে।

- চাইলে আদর ও করতে পারো।

- সামনে থেকে সরুন।

- পেছন পেছন আসবো নাকি?

- আপনি কি করেন?

- স্টাডি করি।

- আপনার বাবা কি করেন?

- বাবা নেই।

-মারা গেছেন?

- না,আসলে আমি জানি না,

- আপনার মা?

-আমার মা আমার জন্মের সময় মারা গেছেন।

- থাকেন কোথায়?

-বস্তিতে,

এক ভিক্ষুকের সাথে। এখন তিনিই আমার মা।

- আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না।

- কেনো?

- ভিখারীর ছেলেকে কি করে বয়ফ্রেন্ড বানাই?

ফকিন্নির ছেলের আবার ভালোবাসার শখ!!

- আচ্ছা।

- কি আচ্ছা?

- আর ডিস্টার্ব করবো না তোমাকে।

- ধন্যবাদ।

.

আমি আর কিছুই বললাম না।নীরবে চলে আসলাম।

আসলে জোর করে ভালোবাসা হয় না। তাছাড়া আমি যেহেতু ভিখারীর সন্তান, সেহেতু এসব ভাবাও আমার জন্য পাপ।

.

আমি আল -ফারাবী। ডাক নাম ফারাবী। ঢাকা শহরের একটা বস্তিতে থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে অনার্স করছি। আমার বাবা কে তা আমি জানিনা।

মা জন্মের সময় মারা গেছেন। মাকে কখনো দেখতে পারিনি।

তাই বড় হয়েছি এক ভিখারীর কাছে। তিনিই এখন আমার মা। কিছুটা বুঝতে যখন শিখেছি, তখন টোকাই দলে নাম লিখেছি। সারাদিন টোকাই গিরি করে যা পেতাম তাতে আমার দিন যেতো।

একদিন পাশের মহল্লার কিছু টোকাই ছেলে আমাকে মেরেছিলো।

তারপর আমার মা (যার কাছে থাকি) তিনি আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আর তিনি ভিক্ষা করতেন।

.

প্রাইমারী পাশ দেবার পর আসি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। বেশ মেধাবী ছিলাম আমি। সবসময় সব ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। পাশাপাশি একটা প্লাস্টিক কারখানাতেও জব করতাম। যে টাকা বেতন দিত, তাতে পেট চলতো।

পড়ালিখার টাকা মা ভিক্ষা করে জোগাড় করতো। মোটামুটি চলে যেতো দিন।

.

খুব ভালো খাবার খেতে পারতাম না।নিম্ন মানের চালের ভাত আর পিয়াজ বা কাঁচামরিচের ঝাল হলেই পেট ভরে খেতাম। মাঝে মাঝে মা ডাস্টবিন হতে বড় লোকদের ফেলে দেয়া আধখাওয়া পঁচা বাসি খাবার

নিয়ে আসতেন।

আমার চোখ খাবার লোভে চকচক করতো। আমি গপাগপ গিলতাম। খাবার শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে মায়ের দিকে তাকাতাম। দেখতাম আমার মায়ের দুচোখে জল চিকচিক করছে


আমি তাকালেই মা মুখ ঘুরিয়ে নিত।

আঁচলে চোখ মুছতো আমাকে আড়াল করে। মাঝে মাঝে বলতো,

"বা'জান, চোকে মনে অয় সমেস্যা দেহা দিচে। খালি পানি পড়ে চোক দিয়া। কবে বড় অবি তুই বা'জান?

আমারে মেম সাব গো মতোন এককান সসমা কিন্না দিবি কবে?"

.

আমার গলা ধরে আসে। আমি তো জানি, আমার

মায়ের চোখের জলের উৎস। আমাকে বড় হতে হবে। অনেক বড়। অনেক......

.

প্লাস্টিক কারখানার চাকরি ছেড়ে দিলাম। মালিকটা খালি প্যানপ্যান করে। কিছু হলেই মায়েরে নিয়া বাজে কথা বলে। দিন চুক্তি রিক্সা নিলাম জাবেদ চাচার থেকে। স্কুলের সময় স্কুলে যেতাম। বাকী সময় রিক্সা চালাতাম।

.

একদিন এক বড়লোকের ছেলে আর তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে গ্রীনরোড থেকে রবীন্দ্র সরোবর যাচ্ছিলাম।রিক্সায় বসে বসে তারা আজ কত টাকার শপিং আর খাবার কিনেছে তার হিসেব করছিলো। আমি মনে মনে খুশি হলাম। ভাড়ার পাশাপাশি চাইলে হয়তো কিছু বখশিসও পেতে পারি ! রবীন্দ্র সরোবরে এসে বললাম, স্যার নামেন। ছেলেটি আর তার গার্লফ্রেন্ড নামলো। ছেলেটি আমাকে একটা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো।

আমি বললাম, স্যার, হয় না তো। আরো দশটা টাকা দেন না। লোকটি আমার গালে থাপ্পড় মারলো। হয়তো এটাই বখশিস ছিলো। লোকটির গার্লফ্রেন্ড বললো,

কি দরকার বাবু? ছোটলোকদের গালে থাপ্পড় মারা? ওদের গালে জীবানু থাকে তো।

কিছু বলিনি। নীরবে চোখের জল ফেলেছি।

গরীবের জন্ম হয়, মার খাবার জন্য।

.

জাবেদ চাচার গ্যারেজে রিক্সা জমা দিয়ে এসে

আমাদের বস্তির খুপরিতে ঢুকলাম। মা বাতাস দিতে লাগলো। আমি মুড়ি খেয়ে পড়তে বসলাম।

সামনে আমার এস.এস.সি পরীক্ষা। অনেক কষ্টে

আমি আর মা ফরমফিলাপের টাকা জোগাড়

করেছি। আমি পড়ছি।

মা বাতাস করছেন। মাঝে মাঝে মায়ের চোখের দিকে তাকাই। মায়ের দুচোখে রাজ্যের স্বপ্ন ভাসে। যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে মা সারাদিনের কষ্ট আর ক্লান্তি ভুলে যায়। আর আমি আমার মায়ের স্বপ্নভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আরো অদম্য হয়ে উঠি। জোরে পড়তে থাকি।

.

এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি দিলাম একসময়।

গোল্ডেন প্লাস পেয়েছিলাম। পত্রিকাতে ছবিও দিয়েছিলো। সাংবাদিক যখন এসেছিলো ছবি নিতে ,

তখন গত রমজানে পাওয়া এক সাহেবের যাকাতের টাকায় কেনা শার্টটা পরেছিলাম। নতুন গন্ধ এখনো যায়নি শার্টটা থেকে। খুব সুন্দর একটা ছবি উঠছিলো। হয়তো নতুন শার্ট নয়তো দামী ক্যামেরার কারনে।

.

আমার মাকে এস.এস.সি এর রেজাল্টের পর

বলেছিলাম, মা, আমি গোল্ডেন প্লাস পাইছি।

তখন আমার মা বলেছিলো, "কিরুম্মা পিলাচ বা'জান?

ওই যে কারেন্টের কাম করে? কত বেচন যাইবো পিলিচটা? বেচতে পারলে এক কেজি চাইল কিনিস।আজকে চাইল নকত বেচন যাইবো পিলিচটা?

বেচতে পারলে এক কেজি চাইল কিনিস। আজকে চাইল নাই।"

.

আমি কিছু বলতে পারিনি সেদিন। কান্না চেপে ধরে

রেখেছিলাম। পরে মা চলে যাবার পর চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। ফুলবানু খালা উঁকি মেরে অবাক চোখে দেখছিলো আমাকে। ভেবেছিলো হয়তো বড় পাশ দিছি,তাই আনন্দে কাঁদছি।

.

একদিন আমি রিক্সার উপর বসে গামছা দিয়ে ঘাম

মুছছিলাম। এমন সময় দেখলাম আমার মা কোনো

এক সাহেবের গাড়ির জানালার পাশে দাড়িয়ে অনুনয় করছে।

"ছার,ও ছার....

আমার পোলারে ভাসিটিত ভত্তি করামু, কয়টাট্যাহা দিয়া সাহায্য করেন না.....আল্লাহ আপনের মঙ্গল করবো।"

সাহেব কি বললো তা আমি শুনিনি। তবে আমার মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো।

আমার মায়ের হাত ভেঙ্গে গিয়েছিলো নিষ্ঠুর কালো পিচঢালা রাস্তার উপর পরে। যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠেছিলো আমার মা। আমি ছুটে গিয়ে মাকে কোলে করে রিক্সায়

উঠিয়ে বস্তিতে নিয়ে আসলাম। আমার মা ব্যাথায় নয়,লজ্জায় চুপসে গিয়েছিলেন। কেননা,আমার সামনে তিনি ধাক্কা খেয়েছিলেন। এটা খুবই লজ্জাজনক।

ডাক্তার দেখাতে পারিনি টাকার জন্য। প্রতিদিন ফুলবানু খালা তেল গরম করে মায়ের হাতে মালিশ করে দিতো।

যদিও মায়ের হাতটা আর সোজা হয়নি, তবে ব্যাথা আস্তে আস্তে কমে গিয়েছে।

.

আমি মাকে একটা টং দোকান ভাড়া করে দিয়েছি। সেখানে মা পান সিগারেট বিক্রি করে।

.

আমি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। আমার অনেক বন্ধু।

একদিন স্যার আমাকে বললেন, ফারাবী,তোমার নিজের সম্পর্কে বলো।আমি সেদিন সব বলেছিলাম। সেদিনের

কথাগুলো বলার পর আমার আর কোনো বন্ধু নেই।

তারা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।কেমন করে যেনো কথা বলে।একদিন তো সায়ান আবিরকে বলেছে,দেখ আবির,ফারাবী ফকিন্নির পোলারে পাত্তা দিবি না। তারা হয়তো ভেবেছিলো, আমিও কোনো বড়লোক নামক গন্ডারের চামড়ার জাত। কিন্ত না,আমি ফকিন্নির সন্তান।

.

পিয়নের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম। এতক্ষন অতীতে ডুবে ছিলাম। আমি এখন ম্যাজিস্ট্রেট। বিসিএস পরীক্ষাতে উর্ত্তীন্ন হয়ে সেদিনকার বড়লোক সায়ান আবিরদের স্যার।

টাকা পয়সা,ধন সম্পদ, মান সম্মান সব আছে।

আছে একটা হাত ভাঙ্গা ভিখারী মা। না,তিনি এখন ভিখারী নন, তিনি এখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট এর মা।

.

সেদিন পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দিলাম পাত্রী চাই

শিরোনামে। ঠিকানা দিয়ে দিলাম। কোনো এক পাত্রীর বাবা বাসায় এসে হাজির পরদিন। আমি আর আমার মা এবং বাসা সব কিছু পছন্দ হলো উনার। উনি উনার বাসার ঠিকানা দিলেন। আমি আর মা পরদিন গেলাম। কোনো একদিন আমি রিক্সা চালাতাম, মা রিক্সায় বসে থাকতো।

আজ আমি নিজের গাড়ি নিজে চালাচ্ছি, আমার মা পাশে বসে আছেন। মেয়ের বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করলাম।

.

ভেতরে ঢুকলাম। মেয়ের বাবা সাদর সম্ভাষন জানালো। মেয়ের মা আমাদেরকে নাস্তা দিলেন। কিছুক্ষণ পর মেয়ে আসলো। লম্বা ঘোমটা দেয়া। বান্ধবীরা নিয়ে এসেছেন। আমার মা বললেন, ঘোমটা সরাতে।

মেয়ের একটা বান্ধবী ঘোমটা সরালো। আমি মেয়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম।

এটা তো ইরি.....

যার পেছনে আমি আমার কলেজ জীবনে ঘুরেছিলাম। ইরি আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো ।

আচ্ছা, সে কি আমাকে চিনেছে? চেনার কথা নয়। সেদিনকার কালো চিকন ফারাবী এখন সাস্থ্যবান আর অনেক স্মার্ট।

আমি বললাম, মেয়ের সাথে আমি একটু কথা বলবো।

সবাই রাজি হলো, আমি আর ইরি ছাদে গেলাম।

.

আমি কয়েকটা কাঁশি দিলাম।

ইরিঃ পানি খাবেন?

আমিঃ নাহ্।

- কেমন আছেন?

- ভালো, তুমি?

- ভালো।

- কি করছো আজকাল ইরি?

- আপনি আমার এই নাম কোথায় পেলেন?

- কেনো?

- না, এম্নি।

- আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?

- জ্বী।

- আমার পরিচয় জানো?

- আপনি একজন ম্যাজিস্ট্রেট। এতটুকু জানি।

- নাহ্,এর বাইরেও কিছু পরিচয় আছে।

- কি সেটা? বলুন।

- আমি ফারাবী।

কোনো একসময় তোমার পেছন ঘুরতাম। কোনো এক ভিখারীর সন্তান আমি। চিনতে পেরেছো?

- আপনি?

আপনি কি করে এতো বড় হলেন?

.

আমি রহস্যময় একটা হাঁসি দিলাম। যে হাঁসির অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম।

আমি ছাদের উপর পায়াচারি করছি। ইরির চোখে মুখে স্পষ্ট বিস্ময় আর অবিশ্বাসের চাপ।

আমি দাড়িয়ে পড়লাম। আকাসের পানে তাকিয়ে আছি।

আজকের বিকেলটা অনেক সুন্দর। কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। পাশের ছাদে কয়েকটা ছেলে মেয়ে দাড়িয়ে আছে।

ইরির দিকে তাকাতে গিয়েও পারছি না। হয়তো এখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। থাকুনা আপাতত কিছু সময় বিস্ময় আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি। প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষকে হতবাক করে দেয়। এটাই হয়তো প্রকৃতির লীলা খেলা। কোথাও যেনো একটা গান বাজছে,

"নদীর এপার ভাঙ্গে, ওপার গড়ে-

এইতো নদীর খেলা।

সকাল বেলার ধনীরে তুই-

ফকির সন্ধ্যা বেলা। 

সমাপ্ত

The End

Previous Post Next Post