কষ্টের ভালোবাসার গল্প | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 খুব কষ্টের ভালোবাসার গল্প

খুব কষ্টের ভালোবাসার গল্প

জামিলের অফিস ছুটি হয়েছে ছয়টায়। এখন রাত আটটা বাজে, সে একটা পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। বাড়িতে যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। জামিলের স্ত্রী রুনা সাড়ে আট মাসের গর্ভবতী। সারাক্ষণ মায়ের বাড়ি যাব করে করে বায়না করে। রুনার এই প্যানপ্যানানি একদম ভালো লাগে না, তাই বাড়ি না ফিরে এই পার্কে বসে থাকা। 


জামিলের কাছে রুনা ছাড়া সব মেয়েকেই ভালো লাগে৷ অফিসের কলিগদের ভালো লাগে, বন্ধুর বউদের ভালো লাগে, এমনকি এই সন্ধ্যায় পার্কে ঘুরে বেড়ানো মেয়েদের দেখতেও ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তার বড়ো ভাবিকে। 


বড়ো ভাবি সুন্দরী, শিক্ষিতা আর অনেকবেশি আধুনিকা। কথা বলার সময় ইংরেজি শব্দই বেশি ব্যবহার করে। ভাবির শাড়ি পরার ঢংটাও বেশ আলাদা। জামিলের ভাবি চাকরি করে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে গোসলের পর ভেজা চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে নিজের বিছানায় আধশোয়া হয়ে কোলে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে টিভি চালিয়ে স্টার জলসা কিংবা জি বাংলার কোনো একটা সিরিয়াল ছাড়লেই জামিল ভাবির ঘরে বসে। 


সিরিয়াল নিয়ে ভাবির সাথে গল্প করে। সিরিয়ালের গল্প চলে রাত দশটা পর্যন্ত। সিরিয়াল দেখার সময় ভাবির মুখের ভাবভঙ্গি জামিলের খুব ভালো লাগে। টিভি দেখার সময় জামিলের স্ত্রী রুনা ভাবির জন্য গরম গরম কফি বানিয়ে দিয়ে যায়। দুই জা'য়ের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান।রুনাকে কখনও এই বাড়ির বউ মনে হয় না। জামিলের কাছে রুনাকে বউয়ের চেয়ে বড়ো ভাবির কাজের লোকই বেশি মনে হয়। 


রাত দশটায় রুনা সবার জন্য রাতের খাবার দেয়। রাতের খাবার খেয়ে জামিল চলে আসে তার বন্ধু মঈনের বাসায়। এইসময় ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না তার। রুনার পেট ব্যথা, মাথা ঘোরানো এসব খুবই বিরক্ত লাগে। অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিয়ে সে বাসায় ফিরে। রুনাও ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে।


বড়ো ভাবি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় আজ বাসায় ফিরতে দেরি করবে, তাই সন্ধ্যায় জামিল বাসায় ফেরেনি। পার্কে বসে থেকে অনেক ভাবনা চিন্তার পর মঈনের বাসার দিকেই রওনা দিলো। 


মঈনের স্ত্রী শম্পা দরজা খুলে জামিলকে দেখে বেশ অবাক হলো। "কী ব্যপার জামিল ভাই? আজ এত তাড়াতাড়ি আসলেন? "

" আপনার সাথে গল্প করতে আসলাম। মঈন ফিরেছে?"

" আমার সাথে গল্প করতে এসে বন্ধুকে খুঁজছেন!" কথাটা বলেই শম্পা উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। জামিল খেয়াল করলো শম্পার গালে পাউডারের প্রলেপ, দরজা খোলার আগেই হয়তো তাড়াহুড়ো করে গালে পাওডার লাগিয়েছে সে। শম্পা হয়তো ভেবেছে তার স্বামী এসেছে, কিন্তু জামিলকে দেখেও সে অখুশি হয়নি। জামিল মেয়েদের সাথে ভালো আড্ডা জমাতে পারে। স্কুল কলেজে সারাক্ষণ মেয়েদের সাথে থাকার জন্য বন্ধুদের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাকে। 


জামিলকে বসার ঘরে বসিয়ে শম্পা রান্নাঘরের দিকে গেল। বসার ঘর থেকেই জামিল শম্পার সাথে গল্প করছে। রান্নাঘর থেকে শম্পার হাসির শব্দ আসছে। গল্পের মাঝখানে জামিলকে একবার রুনা ফোন দিয়েছিল। পেট ব্যথায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সে। এসব শুনেই জামিলের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে ঘুমাতে বললো তাকে। তারপর আবার গল্প শুরু করলো।


জামিল অল্পশিক্ষিত। বেশিদূর পড়াশোনা করেনি। একটা অফিসে অল্প বেতনে কেরানির চাকরি করে সে। জামিলের বড়ো ভাই আর ভাবি দুজনেই ভালো বেতনের চাকরি করেন। জামিলের স্ত্রী রুনা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনোর পর আর পড়াশোনা করতে পারেনি। জামিলের মা জামিলের জন্য নিঁখুতভাবে ঘরের কাজকর্ম করতে পারে এমন একটা মেয়ে খুঁজছিল। 


রুনা চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। চার বছর ধরে বিয়ে হয়েছে তাদের। বিয়ের পর সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছে সে। এই বাড়ি ছেড়ে তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বাবার মৃত্যুর পর ভাইদের সংসারে বড়ো হয়েছে সে। ভাইয়েরা সংসারের খরচ বাঁচাতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা দিয়ে দিছে। মাস ছ'মাসে একবার মায়ের সাথে দেখা করতে যায় সে। এইবার প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর মা নিজ আগ্রহ নিয়েই বারবার বাড়ি যেতে বলছিল। রুনাও চেয়েছিল এই সময়টা থেকে আসতে। ভাইয়ের বউরা হয়তো ঝামেলা করতো তবুও ইচ্ছা ছিল। 


ছোটো থেকেই রুনা তার মায়ের থেকে শিখেছে, শ্বশুরবাড়িতে সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়, মুখে মুখে কথা বলা যাবে না, স্বামীর সংসারই মেয়েদের আসল ঘর। রুনাও তাই সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে। 


বিয়ের পরেই রুনা বুঝেছিল এই বাড়িতে তার জায়গাটা আসলে কোথায়। যার স্বামীর আয় যেমন, শ্বশুরবাড়িতে তার মর্যাদাও তেমন। রুনা মুখ বুঝে সব সহ্য করে। 


রুনা যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন বড়ো ভাবির দুইটা বাচ্চাই একদম ছোটো। রুনা বুঝেছিল, এত তাড়াতাড়ি এই বিয়েটা দেওয়া হয়েছে কেবল বাচ্চা দুইটাকে দেখাশোনার জন্য। বাচ্চা দুইটার দেখাশোনার জন্য রুনা নিজে বাচ্চা নিতে পারছিল না। শাশুড়ি কড়া করেই বলেছিল, আমার বড়ো ব্যাটার নাতি-নাতনীরা বড়ো হবে, স্কুলে যাবে তারপর নিজে বাচ্চা নেওয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করবে, আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গেলে তার ফল ভালো হবে না। 


গর্ভাবস্থাতেও রুনা বাড়ির সব কাজ করে। কখনও একটু শুয়ে বসে থাকলেই শাশুড়ি গালমন্দ করে। জামিলের কাছে যে মন খুলে নিজের কষ্টের কথা বলবে, যন্ত্রণার কথা বলবে তারও উপায় নাই।


 রাতে মঈনের বাড়ি থেকে আড্ডা দিয়ে এসে জামিল রুনাকে বললো, কাল আমি কক্সবাজারে যাব, অফিসের ট্রিপ, দুইদিন থাকতে হবে?


" এই সময়ে না গেলে হয় না? আমার শরীর খুব খারাপ করে নিচ্ছে। "


" আমি কি ডাক্তার না-কি যে তোমার পাশে থাকলেই তুমি ভালো থাকবা? আমার থাকা না থাকা একই। বেশি খারাপ লাগলে মাকে বইলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। "


রুনা আর কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। পরদিন ভোরবেলায় জামিল কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল। 


রুনার শরীর খুব খারাপ লাগছিল। শাশুড়িকে কয়েকবার বলার পরেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি। জামিলকে ফোন দিলে রাগারাগি করে ফোন কেটে দিলো। রুনা বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। এইভাবে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেল। বিকালবেলা শাশুড়ি পাড়ার এক ধাত্রীকে ডেকে আনলো। ততক্ষণে রুনার শরীর খুব খারাপ করে নিয়েছে। শরীরে কোনো বল পাচ্ছে না। ব্যাথায় চোখ খুলতেও পারছে না। মরার মতো পড়ে আছে রুনা। 


সারারাত চেষ্টা করেও বাচ্চা প্রসব করাতে ব্যর্থ হয় সেই ধাত্রী। সকালবেলা রুনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। জামিলও রাতে আবার কক্সবাজার থেকে রওনা হয়ে গেছে। 


হাসপাতালে নেওয়ার আগেই রুনার বাচ্চাটা মারা গেল। মরা বাচ্চাটাকে রুনার কাছে নিয়ে যাওয়া হলে মরা বাচ্চাটাকে দুইহাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখলো। জামিলের মা মৃত বাচ্চার শোকে হাউমাউ করে কাঁদছে। জামিল ডাক্তারদের সাথে চিৎকার চেচামেচি করছে। সবাইকে দেখে নিবো, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারলো না, কেমন ডাক্তার এরা! আরও উলটাপালটা কথা বলছিল। কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী এসে জামিলকে হাসপাতালের বাইরে বের করে দেয়। 


মৃত বাচ্চাটাকে কবর দেওয়ার কাজ শেষ করে জামিল সন্ধ্যায় ফিরে আসে। রুনাকে এখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। জামিল রিকশা ভাড়া করে রুনাকে বললো, রিকশাতে উঠো, বাসায় যেতে হবে। 


রুনা কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। জামিল আরও অনেকবার বললো, রুনা যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। একটু পর সে জামিলের ঠিক করা রিকশাটাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। জামিল খুব বিরক্ত হয়ে রুনাকে সবার সামনেই গালিগালাজ শুরু করে। রুনা কিছুতেই কান না দিয়ে একটা নতুন রিকশা ঠিক করলো। রিকশা ছেড়ে দিচ্ছিল। জামিল এসে আটকালো। 


- আরে কোথায় যাও তুমি? আমিও তো যাব, আমাকে উঠতে দাও। 


- তুমি কোথায় যাবে? আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। আমি আর তোমাদের বাড়ি ফিরবো না। এতদিন তোমাদের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। তোমাদের বাসার সবার সব কাজ করেছি। কখনও মুখ ফুটে কিচ্ছু বলিনি। সবকিছু করেও কারো মন পাইনি। অবশ্য সংসারে যদি স্বামীর মন-ই না পাওয়া যায় তবে অন্য কারো মন দিয়ে কী হয়! আমি তো কোনোদিন তোমাকেই পাইনি৷ ভেবেছিলাম সব মানিয়ে নিবো। কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। অফিসের ট্রিপের কথা বলে তুমি যে শম্পা ভাবির সাথে কক্সবাজার গিয়েছো সেটা আমি সেদিন রাতেই তোমার ফোনে আসা মেসেজ দেখে জেনেছি। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। আমি অল্প শিক্ষিত হতে পারি, কিন্তু অশিক্ষিত না। কোনো না কোনো কাজ ঠিক জুটিয়ে নিবো। তোমার কিংবা ভাইদের দ্বারস্থ কোনোদিন হবো না। আর রইলো কথা সমাজের, যার যা খুশি ভাবুক! সমাজের কথা ভেবে নিজেকে আর বলি দিতে পারব না। গেলাম।


জামিলের চোখের সামনেই রিকশাটা সাঁই করে চলে গেল। 


স্বামীর সংসার থেকে বের হয়ে আসা একটা মেয়ের জন্য এই সমাজে একা চলাটা খুব কঠিন। কিন্তু রুনা পারবে, সব বাঁধা অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্নটা দেখছে বলেই তো ঘর ছেড়েছে সে, তাকে তো পারতেই হবে.....।


( সমাপ্ত)


গল্পঃআত্মপরিচয়

-ইসরাত ইমু


এমন আরও অনেক কষ্টের গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post