শিক্ষনীয় বাস্তব গল্প
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অর্থাৎ হিজড়া'রা থাকে। ওদের বেলকনি আর আমাদের বেলকনি প্রায়ই মুখোমুখি।
আমার সাত বছরের ছেলেটার সাথে ওদের বেশ ভাব। একদিন দেখলাম বেলকনি থেকে ওরা কিছু পুলি পিঠা একটা কাগজের ঠোঙায় ভরে আমার ছেলেকে দিচ্ছে। আমায় দেখা মাত্রই ওদের মধ্যে কয়েকজন বেলকনি থেকে দ্রুত রুমে ঢুকে পড়লো। বাকি দু'জন ছিলো একজন হয়তো ওদের দলের প্রধান। সে আমায় দেখে অপরাধীর ন্যায় বললো,
- ও'কে কিছু বলিস নারে বোন। ওর কোনো দোষ নাই। আমরাই ডাকছি ওর সাথে গল্প করবো বলে।
আমি আমার ছেলের হাত থেকে পিঠার ঠোঙাটা একটানে কেড়ে নিয়ে বেলকনি দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললাম। ছেলেটা আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। ওপাশের বেলকনিতে থাকা ওই দু'জনও অবাক নয়নে আমায় দেখছিলো।
.
এর মাঝে চলে গেছে দুইটা সপ্তাহ। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম সেদিনের পর থেকে আমার ছেলে বা ওরা কেউ-ই আর কথাবার্তা বলবে না। কিন্তু না আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আমার ছেলে আরেকদিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ওদের সাথে গল্প করছিলো।
আমার সেদিন রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছিলো। পেটে সাত-মাসের বাচ্চা এই সময় এতো উত্তেজিত হলে চলবে না। ঠিক করলাম ছেলেকে রুমে এনে কয়টা কথা শুনিয়ে দেবো। ভাবনা মোতাবেক বেলকনির দিকে পা বাড়াতেই কানে এলো,
- আচ্ছা আন্টি বলোতো আমার আম্মু কেন তোমাদের পচ্ছন্দ করে না? আমাকেও বকে যেন তোমাদের সাথে কথা না বলি। আমার আম্মু বলে খারাপ মানুষদের সঙ্গে মিশতে নেই৷ তাহলে কি তোমরাও...
কথাটা শেষ করার আগেই আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। ঠাস করে ছেলেটার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। আমার ছেলেটা তখন গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে গেলো। আমি রাগে কটমট করতে করতে ওদের উদ্দেশ্যে বললাম,
- আর একদিন যদি তোমাদের আমার ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেছি আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।
ওদের মধ্যে থেকে একজন কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
- এই তুই বলার কে রে হ্যাঁ? ওইটুকু বাচ্চা কি তোদের মতো না-কি রে যে এত ভেদাভেদ বুঝবে? এতো অহংকার ক্যানো রে তোদের?
.
ওই ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় মাস-খানেকের মতো। গতকাল মাগরিবের সময় আমার প্রসব ব্যাথা শুরু হয়। বাসায় আমি, আমার স্বামী, ছেলেটা আর কাজের রোকেয়া খালা ছাড়া কেউ থাকে না। আমার স্বামীতো অফিসেই আছে। এদিকে খালা বিকেলে বাজার করতে গেছে তখনও ফেরেনি। ব্যাথায় যখন কাতরাচ্ছিলাম আমার ছেলেটা দৌঁড়ে আমার কাছে একবার এসে আমায় এই অবস্থায় দেখে কোথায় যেন ছুটে যায়।
কয়েক মিনিট পর আমার ছেলের পেছন পেছন পাশের ফ্ল্যাটের সেই হিজড়াগুলো এক এক করে আমার রুমে প্রবেশ করলো। আমি আবছা চোখে দেখলাম ওরা আমায় ধরাধরি করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।কথা কাব্য পেজে ফ লো দিন।
সকালে আমার স্বামীর মুখে শুনলাম সারারাত ওরা কয়েকজন আমার কেবিনের বাইরেই ছিলো।
নিজের ভুলগুলোর জন্য কতটা অনুতপ্ত আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। ওরাও যে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ এই চরম সত্য কথাটা আমরা কেন যেন ভুলে যাই। হয়তো ইচ্ছাকৃত'ই মনে রাখতে চাই না।
আমার স্বামী কে বললাম ওদের ভেতরে আসতে বলো। এক এক করে ওরা দশ-বারোজন আমার চারিদিকে ঘিরে দাঁড়ালো। আমি বললাম,
- তোমাদের সাথে করা আচরণের জন্য আমি লজ্জিত। পারলে ক্ষমা করে দিও।
ওদের মাঝে প্রধান যে তার নাম জহুরা। সে বললো,
- তুই আর মাইয়া যে সুস্থ আছিস আমরা তাতেই খুশি বোন।
আমার স্বামী ওদের কে বললো আমাদের সাথে গ্রামের বাড়িতে যেতে। সেখানে মেয়ের আকিকা হবে। মেয়ের নামও ওরাই যেন রাখে।
হয়তো এটার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। খেয়াল করলাম ওদের সবার চোখে পানি টলমল করছে। কথাটা শুনে একজন আরেকজনের সাথে চোখাচোখি করছে।
জহুরা ছলছল চোখে বললো,
- ভাইজান আমরা কি এতটাও সম্মান পাওয়ার মতো মানুষ?
আমার স্বামী জবাবে বললো,
হ্যাঁ তোমরাও মানুষ। আমাদের মতোই মানুষ। আর সম্মান পাওয়ার মতো মানুষতো সবাই হয় না। যারা সম্মান দেয় শুধু তারাই সম্মান পায়।
-ওরাও_মানুষ
-সোনিয়া শেখ