স্বামী স্ত্রীর কষ্টের গল্প | পরকিয়া প্রেমের স্ট্যাটাস

 পরকিয়া গল্প

পরকিয়া গল্প

ক্ষমা!

সতের বছরের সংসারে তার দুটো সন্তান আছে। বড়জন ছেলে, বয়স ষোল আর ছোটটা মেয়ে চৌদ্দ। তার স্ত্রীও উচ্চশিক্ষিতা, ঢাকার নামী একটা বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছে। সে নিজেও একটা মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানির উচুঁ পদে। ইন্দিরা রোডে নিজেদের ফ্ল‍্যাটে আপাত সুখের এক সংসার। এসব কিছু রেখেও আমার স্বামী রাশেদ অন‍্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রথমবারের মত কথাটা শুনে ভীষণ অবাকই হয়েছিলাম। বিয়ের আগেও রাশেদের সাথে আমার তিন বছরের সম্পর্ক, প্রেমিকা হিসেবে। সবমিলিয়ে আমাদের দুই দশকের রিলেশনশিপে তৃতীয় ব‍্যক্তির আগমন, অন্ততপক্ষে আমি কখনো চিন্তা করিনি। 


তাইতো বন্ধুর কথায় বিশ্বাস না করে নিজে একটু যাচাই করার চেষ্টা করলাম। হ‍্যাঁ, রাশেদ তার হাটুর বয়সী এক অফিস কলিগের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে। ওর অফিসে বেশ অনেকদিন ধরেই এটা ওপেন সিক্রেট। দেশ বিদেশে অফিস ট‍্যূরে ওদের একসঙ্গে যাওয়ার কথাটা জানতে পেরে আমার গা গুলিয়ে বমি আসলো। হায়রে পুরুষ মানুষ, তোমাদের পক্ষে ঘরে বাইরে সব জায়গাতে এক সাথে স্বাদ নেওয়া সম্ভব!


রাশেদের সাথে কিন্তু আর সংসার করিনি। তবে চুড়ান্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রায় মাস ছয়েক ধরে হাজারো নাটক মঞ্চস্হ হল। আমাকে সামাজিক ভাবেও হেনস্থা হতে হল রাশেদের করা উদ্ধত আর অনৈতিক আচরণে। যে মেয়েটার সাথে রাশেদের সম্পর্ক তার নাম তুলি, মেয়েটার স্বামী এতোটাই খেপেছিল যে রাশেদ আর তুলির আপত্তিকর ভিডিও কিভাবে যেন সংগ্রহ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ‍্যমে ছড়িয়ে দেয়। 


মুহূর্তেই ভাইরাল হওয়া অশ্লীল সেই ভিডিও প্রকাশে সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমাদের দু সন্তান। পুরো ঘটনায় মানসিক বিপর্যস্ত এই দুজন নিজেদেরকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়। এরপর ওরা বলতে গেলে বাসা থেকে বেরই হতো না। আর পাঠক আমার অনুভূতির কথাটা বা নাই ই শুনলেন। শুধু একটাই কামনা, কখনো যেন আর কোন মেয়ের এই পরিস্থিতির মধ‍্য দিয়ে না যেতে হয়। প্রায় আট বছর আগের সেই ঘটনা মনে হলে এখনো শিউরে উঠি। পাড়া প্রতিবেশীতো দূর কি বাত কাছের আত্মীয় স্বজনেরাও আমার ঐ কঠিন সময়ে পাশে থাকেনি।


অনেক ভেবেছি, আজ পযর্ন্ত একটা প্রশ্নের উত্তর পাইনি "রাশেদ কেন আরেকটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল?" আমার সাথে তার সম্পর্ক কোন টানাপোড়েনের মধ‍্যে নেই। আরো আট দশটা স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের মতোই, হয়ত ব‍্যস্ততায় বা সময়ের নিয়মে আমাদের সম্পর্কের উত্তাপটা কমে এসেছে। তবে ভালোবাসা আমার দিক থেকে মরে যায়নি, রতিক্রিয়াও হত নিয়মিত। তাইতো ওর আচরণ কখনো আমার মধ‍্যে সন্দেহ তৈরী করেনি। বাচ্চা দুটোও কিন্তু বরাবরই "বাবা" "বাবা" বলতে পাগল। সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের ভালো অবস্হা। আত্মীয় স্বজনরাও সুখী পরিবার হিসাবেই জানে। এ রকম সুখের সময়ে রাশেদের নৈতিক স্খলন, আমিতো অবশ‍্যই এমনকি বাচ্চা দুটোও মেনে নেয়নি। ভাবতেই গা রি রি করে, ডিভোর্স দেওয়ার আগেই এই লোকটা একটা মেয়ের সাথে থাকতে শুরু করে দিয়েছে বলে। মানুষ কতোটা নীচে নামতে পারে তা এই রাশেদকে কাছে থেকে না দেখলে জানতে পারতাম না।


রাশেদের পরকীয়ার বিষয়টি প্রথম প্রথম বাদল নামের ছেলেটার কাছ থেকেই জানা। বাদলও কিন্তু এই পরকীয়ার বলি, তুলির স্বামী। তবে রাশেদ তুলির ভিডিও প্রকাশ করার পর থেকে আমি আর ঐ ছেলেটাকে বাদলকে প্রশ্রয় দেইনি। সত‍্য বলতে কি, রাশেদকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পর দুই সন্তানকে নিয়ে আমি এক প্রকার বিচ্ছিন্ন জীবনে। এমনকি আপন ভাইবোনদেরকেও এড়িয়ে চলেছি। 


রাশেদ অবশ‍্য আমার নামে লিখে দেওয়া ইন্দিরা রোডের এই ফ্ল‍্যাটটির মালিকানা দাবি নিয়ে কখনো আসেনি। এরপর বাচ্চা দুটোর সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টায় ব‍্যর্থ হয়ে ওর নতুন প্রেম তুলির সাথে সুখ খোঁজার অন্বেষায়। পরে মনে হয় মেয়েটাকে ও বিয়েও করেছিল। তবে শোনা কথা, বছর খানেকের মধ‍্যেই ওদের আবার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়, রাশেদকে নাকি মেয়েটা নিঃস্ব ও রিক্তও করে। দুটো মানুষই যদি লোভী হয়, সেই সম্পর্কের পরিণতিটা এরকম হবে। এটাই কিন্তু অনুমিত ছিল।


এরপর রাশেদের কি অবস্হা, ওর কোন খবর জানেন? 


প্লিজ, আমাকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। মেয়েটার সাথে চলে যাওয়ার পর, আমার ওর বিষয়ে কোন রকমের আগ্রহ ছিল না বা এখনো নেই। দ্রুত ডিভোর্সের পেপারসটাই তখন রেডি করেছিলাম, এ ধরনের জঘন্য মানুষের ছায়া যাতে আর কখনো না মাড়াতে হয় বলে। বাচ্চা দুটো সম্ভবত আমার চাইতেও বেশি ঘৃণা নিয়ে বড় হতে লাগল। কখনোই ওরা ওদের বাবার কথা মুখে আনেনি। আমিও ওদের বাবার প্রসঙ্গ আলোচনায় আনতাম না। কলেজের চাকুরীটার সাথে বাবা মায়ের সাপোর্ট, দুটো বাচ্চা নিয়ে চলতে খুব একটা সমস্যা হল না। আমার ছেলে তাশরিফ এইতো এ বছর বুয়েট থেকে পাশ করলো, মাস্টার্স করতে এখন আমেরিকা যাওয়ার তোরজোরে আছে। মেয়েটার নাম ফারিন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে এ বছর সেকেন্ড প্রফ শেষ করলো। পড়াশোনায় দুজনই তুখোড়।


আগামীকাল একত্রিশে মে, আমার জন্মদিন। স্বভাবতই আমার আজ উচ্ছ্বসিত থাকার কথা। কিন্তু গত চার বছর ধরে এই ত্রিশে মে তারিখটায় আমার মধ‍্যে ভয়ানক এক কষ্ট ভর করে। এই দিনে একটা বিব্রতকর ও খারাপ অভিজ্ঞতার মধ‍্য দিয়ে যেতে হয়েছিল বলে। ট্রমাঔ বলা চলে। যদিও গোপন এই কষ্টটার কথা আমি কারো সাথে শেয়ার করিনি, আজই প্রথম আপনাদেরকে বলা। 


চার বছর আগে এই তিরিশে মে তে আমার এক্স হাজবেন্ড রাশেদ মারা যায়, খুব করুন সময়ের মধ‍্য দিয়ে ওর কষ্টের সেই মৃত্যুটা আমার নিজেরও খুব খারাপ লেগেছিল। তবে আমি নিজে সবসময়ই চেয়েছি এই দিনটার কথা ভুলে যেতে, তবে এখনো পযর্ন্ত তা পারিনি। এ দিনটা আসলেই অনেক কথা মনে পড়ে যায়। মাঝে মধ‍্যে ছিন্নভিন্ন এই পরিবারটার কথা ভেবে যা মনে হয়, আমাদের কারোর জীবনইতো এমন হওয়ার কথা ছিল না।


চার বছর আগের সেই দিনটার কথাই এখন আপনাদের বলছি। 


কলেজে ক্লাস নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিব। ঠিক এমন সময় আমার বড় ননদের ফোন "সাথী, তুমি কি একটু সোহরাওয়ার্দীতে আসতে পারবে বোন? রাশেদ সম্ভবত আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। ডাক্তার সে রকমই আভাস দিয়েছে। এটা নিয়ে ওর থার্ড টাইম হার্ট এটাক, এ যাত্রায় ওর বেঁচে উঠার সম্ভবনা নেই। ও তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাইছে। যদি একটু আসতে?" রাশেদের বড় বোন শুধু নয়, ওদের পুরো পরিবারের সবাই আমাকে সবসময়ই শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ওরা কখনোই রাশেদের করা অন‍্যায়কে সাপোর্ট করেনি, এ কথা আমার খুব ভালো করে জানা। আর তাশরিফ আর ফারিন আমার দু ছেলে মেয়েকে ওদের পরিবারের সবাই ভীষণ ভালোবাসে। যদিও পারতপক্ষে ঐ পরিবারের সবাইকে আমরা এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করি।


রাশেদের বড় বোনের অনুরোধটাকে কোনরকম চিন্তা না করে এক মুহূর্তেই না করে দেই। ভদ্রমহিলাও দ্বিতীয়বার আমাকে রিকোয়েস্ট করেনি। এরপর বাসায় ফিরে প্রথম বারের মতো আমার বাচ্চা দুটোকে কাতর অনুরোধ করলাম। মৃত্যু পথযাত্রী ওদের জন্মদাতা পিতাকে শেষবারের মতো দেখে আসার জন‍্য। শত হলেও লোকটা ওদের বায়োলজিকাল ফাদার। আমার ছেলে নিমরাজি থাকলেও মেয়েটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। ওদের চোখেমুখে ফুটে উঠা ঘৃণা দেখে আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল। খানিকটা ইমোশনাল ব্ল‍্যাক মেইলিং করেই ওদের দুজনকে শেষ পযর্ন্ত হাসপাতালে পাঠাই। 


"মা, বাবার শরীরটা একেবারেই খারাপ। আমার আর ফারিনের হাত ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। সবকিছুর জন‍্য ক্ষমাও চাইলো। আমার খুব খারাপ লাগছে মা। তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়। একটু বলো মা, আমার অনুরোধ।" পৃথিবীর সব কিছু ফেলতে পারি, ছেলে মেয়েদের কথা নয়। ফোনটা ধরতেই অস্ফুট স্বরে ওপর প্রান্ত থেকে "সাথী, সবকিছুর জন‍্য পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।"


আশ্চর্য হলেও সত‍্য, মৃত্যু পথযাত্রী এই লোকটা, যে কি না এক সময়ের আমার ভীষণ ভালো লাগা প্রেমিক। আর পরবর্তীতে সতের বছর সংসার করা বিশ্বস্ত এক স্বামী। ওর কান্না জড়িত কন্ঠে বলা কথাটা আমাকে একটুও স্পর্শ করলো না। রাশেদ সে রাতেই লাইফ সাপোর্টে চলে যায়, পরদিন মারাও গেল।  


গত কয়েক বছর তিরিশে মে আসলেই সম্ভবত পর দিন আমার জন্মদিন বলেই বিশ্বাসঘাতক প্রাক্তন স্বামীর কথা মনে পড়ে যায়। একটা সুখের সংসার তছনছ করে, নিজেও অল্পবয়সে অসুস্থতা বাড়িয়ে মরে যেতে বাধ‍্য হলো। অথচ আমাদের কারোর জীবনই কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না। তাইতো রাশেদকে তার মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও ক্ষমা করতে পারিনি, আজো সে আমার কাছে ভয়ানক রকমের দোষী একজন। মানুষের করা কিছু কিছু অপরাধ চাইলেও ক্ষমা করা যায় না, আর করাও উচিৎও নয়।


                       সমাপ্ত

এমন আরও একটি পরকিয়া প্রেমের গল্প।

Previous Post Next Post