বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | চরম বাস্তব কিছু তেতো কথা

বাস্তব জীবনের গল্প

বাস্তব জীবনের গল্প

 "সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা যখন নেই তো আমার ছেলের ঘাড়ের ওপর পরে আছো কেনো??এবার তো ওকে রেহাই দাও।তোমার দোষের শাস্তি কি আমার ছেলেকে পেতে হবে?চার বছর পরলো এখনো তাকে বাবা ডাক শোনাতে পারলেনা।বলি কি আমরা দাদা দাদী ডাক না শুনেই কবরে চলে যাবো??"


কথাগুলো বলে রাগান্বিত হুঙ্কার দিয়ে শ্বাশুড়ি চলে গেলেন।আমি আগের ন্যায় কাপড় গুছচ্ছি।নিত্যদিন এসব শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছি। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন গায়ে লাগেনা।এখন রুমে গিয়ে আমার শ্বশুরের সামনেও আমার নিন্দা করবে।রোজ আমার হাসবেন্ড আর শ্বশুরের কাছে আমার নামে নিন্দা না করলে ওনার ভাত হজম হয়না।এতে দুজনি বিরক্ত হয় তবুও কিছু বলেনা কারণ প্রথমবার বলতে গিয়ে শ্বশুর আর আমার স্বামীকে প্রচুর সমস্যা ফেস করতে হয়েছে। শ্বাশুড়ি আমার রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে ফেলেছিলেন।তাই আমি নিষেধ করি ওনি বলে গেলেও যাতে কেউ কিছু না বলে।


আমাদের বিয়েটা না এরেঞ্জ আর না লাভ। আমার কাজিনের বিয়েতে ওনি আমায় দেখেছিলেন আর প্রথম দেখাতেই আমাকে ওনার মনে ধরে যাকে বলা হয় লাভ এট ফার্স্ট সাইড।অতএব বাবা মাকে বুঝিয়ে বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানো হয়।আমার শ্বশুর পছন্দ করলেও আমার শ্বাশুড়ি আমাকে তেমন পছন্দ করেনি।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়েটা হয়।আমার স্বামী যথেষ্ট আদর্শবান একজন মানুষ। এতো বছরেও না তার ব্যবহার পাল্টিয়েছে আর না তার ভালোবাসা। বিয়ের দু বছর পার হওয়ার পরও আমাদের বাচ্চা হলোনা।প্রথমে সবাই বলতো হয়তো বংশানুক্রমে অনেকের বাচ্চা দেরীতে হয়ে থাকে তাই প্রথমে বিষয়টা গুরুত্ব না দিলেও পরে আমার শ্বাশুড়ি বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তিত হন।তখনি তিনি আমাদের চিকিৎসার কথা বলে।এর জন্য যত কবিরাজি ওষুধ আছে সবকিছু আমাকে আর আমার স্বামীকে এনে দেন।যে যা বলেছে তিনি সবটা করেছেন একটা বাচ্চার জন্য। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম।আসলে চিন্তাটা যে একান্ত তার তা নয় আমরাও চিন্তিত ছিলাম বিয়ের এতো বছর পরও কেনো বাচ্চা হচ্ছে না।দেশের সকল ডাক্তারের চিকিৎসা শেষ করে বাইরের দেশেও গেলাম। বিভিন্ন টেস্ট আর পরীক্ষা করে যা জানলাম তাতে বুঝলাম আমি কখনো মা হতে পারবোনা।যখনি আমার শ্বাশুড়ি এসব কথা জানলেন তখন থেকে আমি তার কাছে বিষ হয়ে গেলাম।এমনিতে বউ হিসেবে আমাকে অপছন্দ করতেন এখন তো আরও বড় অপশান পেলো কথা শোনানোর।প্রথমে ওনার অবর্তমানে কথা শুনাতেন যখন দেখছে কোনো উপায় হচ্ছে না তখন ওনার সামনে এসব কথা বলতেন।পান থেকে চুন খসতে দেরী কিন্তু আমাকে বাজা ডাকতে ওনার দেরী হতো না।বাহিরের মানুষের সামনেও ওনি আমাকে অপমান করতেন তবুও চুপ থাকতাম কারণ যতই হোক প্রতিটি বাবা মা চাই তার সন্তানের প্রজন্মকে দেখতে যেটা হয়তো তিনি পাবেন না তাই আমার ওপর মেন্টেলি টর্চার করেন।একটা বছর তিনি আমার সাথে দূুর্ব্যবহার করেন কিছু বলিনা হাসিমুখে শুনে যায়। আমার স্বামী ওনার রুমে গেলেই বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে আমি আড়াল থেকে সবটা শুনি। ওনারা এ বিষয়ে অনেক তর্ক করেন কারণ আমার স্বামী আমাকে ছাড়তে চাননা।মানুষটা আমাকে বড্ড ভালোবাসে ওনাকে ছাড়া আমি নিজেকেও কল্পনা করতে পারিনা সেখানে ছেড়ে যাওয়া........।


খাওয়ার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।আমি সবাইকে সার্ভ করছি।এমন সময় শ্বাশুড়ি মা আমার বরকে বিয়ের কথাটা আবারও তুল্লেন।তিনি কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগী হলেন।ছেলের সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার মা একটু রেগে গেলেন।তিনি এবার উচ্চ শব্দে জিজ্ঞেস করলেন,


""কি সমস্যা তোর কানে কি কথা যায় না??আর কতো এভাবে দিন কাটাবি?আমাদের কি ইচ্ছে নেই ছেলের বাচ্চা দেখার।এ বাজা মেয়েটার দোষে তুই কেনো শাস্তি নিবি??আমি তোর আবার বিয়ে দিবো।এ বাজা মেয়েকে..... ""


শ্বাশুড়ি মা কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগে আমার বর রেগে উঠে দাঁড়ালেন।অগ্নি চোখে কিছুক্ষন মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে জবাব দিলেন,


""মা তোমার সমস্যা কি? কাকে তুমি বাজা বলছো যেখানে সমস্যাটায় আমার।বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আমার স্ত্রীর আছে মা বরং তোমার ছেলে সেই ক্ষমতা হারিয়েছে।সন্তান জন্ম দেওয়ার পুরো ক্ষমতার মধ্যে ৭০% ক্ষমতা আমার নষ্ট হয়ে গেছে। ৩০ % ক্ষমতা আছে তাতেও বাচ্চা হবে কিনা সন্দেহ। এ বিষয়ে ডাক্তার জানিয়েছেন বাচ্চা না হওয়ার সম্ভবনা ৯০ %।আচ্ছা মা তোমরা শ্বাশুড়িরা কেনো বউদের মেয়ের মতো মানতে পারোনা।কেনো তোমরা সেই নিয়মটা পালন করো যে যুগ যুগ বউরা শ্বাশুড়ি দ্বারা নির্যাতিত হবে।কেনো মা তোমরা বউদের মা হতে পারোনা।এতোদিন তুমি আমার বউকে উঠতে বসতে অপমান করতে, বাজা বলতে আজ তো পুরো সত্য জানলে এখন তুমি কি বলবে? ও আচ্ছা এখন কিছু বলবে না কারণ দোষটা তো নিজের ছেলের কিন্তু যেই না পরের মেয়ের দোষ দেখলে ওমনি তাকে অপমান করতে ছাড়লে না।মা আজ যদি তোমার ছেলেকে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন আর বাইরের মানুষ এ বিষয়ে কথা শোনায় তোমার নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে।তাহলে ঘর ছাড়া, পরিবার ছাড়া মেয়েটাকে যে দিনের পর দিন অপমান করলে তা যদি তার পরিবার জানতো কেমন লাগতো?তোমাদের মতো কিছু মায়ের ব্যবহারের জন্য আমাদের মতো ছেলেরা সবসময় ছোট হয়ে যায় শ্বশুর বাড়ির কাছে, স্ত্রীদের কাছে।"


কথাগুলো বলে এক গ্লাস পানি খেয়ে তিনি চলে গেলেন।ওনার কথা শুনে আমি অনেকটা চমকে উঠলাম।কারণ এসব কথা আমি আর ডাক্তার ছাড়া কেউ জানতো না।আমি নিজেই ওনাকে জানায়নি ভেবেছিলাম সময় নিয়ে জানাবো কিন্তু তার আগে.....।


একটু আগে খাওয়ার টেবিলে যে ঝড় বয়ে গেছে তারপর সবকিছু নিরব হয়ে গেলো।শ্বশুর আব্বা আপন মনে খেয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে সবকিছু স্বাভাবিক।আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাতে দেখলাম তিনি খাবার পাতে শক্ত হয়ে গেছেন। বিশ্বাস করতে পারছেন না একটু আগের কথাগুলো।আমি কিছু না বলে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।


বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে মুখ করে আছেন।কিছুটা এগোতে কান্নার শব্দ কানে এলো।নিরবে পাশে দাড়াতে, 


"তুমি এসব কথা আগে কেনো বল্লে না??কেনো এতোদিন মায়ের এতো নোংরা কথা হজম করেছিলে।সত্যিটা না জানলে আজীবন তোমাকে ওসব বাজে কথা শুনতে হতো।ভাগ্যিস সেদিন ঐ রিপোর্টগুলো হাতে পরেছিলো বলে!"


চুপচাপ শুনছি।বুঝলাম সব সত্য তার জানা হয়ে গেছে। নিরবতা ভেঙে তিনি আবারও বল্লেন,


"যা হওয়ার হয়েছে। এমনিতেও তোমার জীবন তো অনেক সময় আমি নিয়েছি।এখনো সামনে অনেক লম্বা জীবন পরে আছে। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো।তুমি আবারও সংসার করো।আমার জন্য তুমি তোমার জীবন নষ্ট করতে পারোনা।তুমি কেনো মা হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে??"


মনযোগ দিয়ে সবটা শুনলেও কিছুটা অভিমান করলাম।


"তোমাকে ছাড়তে হবে বলেই এতোদিন সত্যটা লুকিয়ে ছিলাম।আমি যেদিন সবটা জানলাম সেদিন খুব কান্না করছিলাম কেনো জানো?মা না হওয়ার জন্য না তোমাকে ছাড়তে হবে এটা ভেবে।কারণ আমি জানতাম তুমি এসব জানলে আমাকে ডিভোর্সের কথা বলবে।তোমাকে ছাড়ার হলে যেদিন সত্যি জানলাম সেদিনই ছেড়ে দিতাম।আমি নতুন সংসার করলে হয়তো সন্তান পাবো,নতুন মানুষ পাবো কিন্তু সত্যি বলোতো সেই মানুষ কি তোমার মতো হবে,তোমার মতো লাভিং কেয়ারিং হবে তাহলে শুধু মাএ সন্তানের জননী হওয়ার জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে ছাড়বো?আজকে তোমার সমস্যা না হয়ে যদি আমার হতো তবে তুমি কি পারতে নতুন সংসার করতে??আমি বিশ্বাস করি আমার স্বামী কখনো এ কাজ করতে পারতোনা।তাহলে আমি কীভাবে করবো বলো তো।আমাদের নবীজির ছোট বিবি আয়েশা (রাঃ) কথা জানো তো,তিনি খুব অল্প বয়সে নবীজির বিবি হোন।তখন আমাদের নবীজি কতো বড় ছিলেন।মা আয়েশা যখন প্রাপ্ত বয়সে গেলেন তখনি নবীজি ইন্তেকাল করেন। চাইলে তিনিও সংসার করে মা হতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি আজীবন নবীজির ভালোবাসা নিয়ে বিধবা বেশে নিঃসন্তান কাটালেন।এ থেকে বোঝা যায় সন্তান ছাড়াও জীবন পার করে যায় যদি একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দৃঢ় থাকে!!"


"যতই এসব বলো না কেনো সত্যি কখনো পরিবর্তন হয়না।বাইরের চাঁদটা দেখছো আজ অনেক আলোকিত।চাঁদের দেখা মিলে রাতের অন্ধকারে আর সত্যের দেখা মিলে মিথ্যাের বেড়াজালে।যতই রাত অন্ধকার হোক না কেনো চাঁদের হালকা আলোতে কিন্তু অন্ধকার কেটে যায় তেমনি জীবনটা এমন!!সত্যটা মিথ্যার আড়ালে কখনো থাকনা।"


দীর্ঘ শ্বাস নিলাম কারণ আমি জানি ওকে এখন কিছু বোঝানো সম্ভব না। তবুও আরো একটা কথা জানানো প্রয়োজন তাই নিজেই বল্লাম,


"শোন না তোমার পারমিশন ছাড়া আমি আরেকটা কাজ করে ফেলেছি। আসলে এক সপ্তাহ আগে আমি একটা অনাথ আশ্রমে যায় সেখানে একটা তিন মাসের শিশু আছে। আমরা চাইলে তাকে এডপ্ট করতে পারি তাহলে সেও বাবা মার আদর পেলো আর আমরাও সন্তান পেলাম কি বলো??"


কথাটা মুখ থেকে বের করতেই ওনি আমাকে ঝাপটে কান্না শুরু করলো।বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ জমে থাকা মেঘটা আর বৃষ্টির ধারা আটকে রাখতে পারলোনা। তাই সুযোগ পেতে অশ্রু হয়ে ঝরে পরলো।তার অশ্রুবিন্দু এতোটা প্রবল ছিলো যে আমার পুরো কাঁধ থেকে জল গড়িয়ে সারা পিঠে ছড়িয়ে পরলো।তাকে থামালাম না, চাইছিলাম ঝরে পড়ুক তার দুঃখের কান্নাটুকু।হালকা হোক মন।পৃথিবীতে মেয়েরা যতটা সহজে কাঁদতে পারে চাইলেও ছেলেরা সেটা পারেনা তাই তো তাদের কষ্ট তাদের ভেতর পাহাড় হয়ে থাকে।আমি চুপিচুপি তার চুলে হাত বুলাতে লাগলাম আর আল্লাহকে বল্লাম এ যেনো আমার প্রিয়র শেষ কান্না হয়।আমি বিশ্বাস করি আমার ভালোবাসা তার চোখের অশ্রু মুছে ঠোঁটের হাসি ফুটাবে।আমি অপেক্ষায় রইলাম সেই সময়ের জন্য!!! 


সমাপ্ত

-তানিয়া_আনিতা


এমন আরও বাস্তব জীবনের গল্প ও ঘটনা পড়ুন।

Previous Post Next Post