অনেক কষ্টের গল্প | চাপা কষ্টের স্ট্যাটাস

 অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

আমি জেনেবুঝে আমার স্ত্রীকে মানসিক অত্যাচার করতাম। শারীরিক নির্যাতন করিনি, সেটা করলে তো লোকে জানবে, দেখতে পাওয়া যাবে, প্রমাণ পাওয়া যাবে আমি অত্যাচার করি। তাই গায়ে হাত তোলার ভুল করিনি। যদিও হাত নিশপিশ করতো। মানসিক নির্যাতনের জন্য তো কোন আইন নেই, শাস্তি নেই। পরিবার, সমাজের কাছে সেটা কোন ব্যাপারই না। নীরবে নিভৃতে চলতে পারে এই অত্যাচার।


কাপড় আয়রন হয়নি, নাস্তা কই, রুমাল কই এই সব বলে বলে সকালেই অস্থির করে তুললাম তাকে। সে অবশ্য সব কিছু ঠিকঠাক করে রাখতো, তবুও মাঝে মধ্যে কিছু ভুল হলেই বাসা মাথায় তুলে ফেলতাম।

অফিস থেকে বাসায় ঢুকেই খুঁজতাম কি ভুল ধরা যায় ওর। ফিল্টারে পানি থাকে তবুও জগে পানি না থাকলে জগ আছাড় দিতাম না হয় ফেলে দিতাম। আমার স্ত্রী ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতো। ক্ষুধা লাগেনি তার পরও টেবিলে কেন খাবার দেয়া নেই এই নিয়ে চিৎকার করতাম। সে ভয় পেয়ে খাবার দেয়া শুরু করতো। 

বলতাম,'সংসারে তোমার কোন মনোযোগ নাই, মন কই থাকে?' 

 সে হয়তো বারান্দায় গেছে কাপড় মেলতে বা তুলতে আমি নিঃশব্দে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বলতাম,"বারান্দায় কাকে দেখতে আস, এতক্ষণ লাগে।" সে তখন কপাল কুঁচকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাতো। 

এই একটা জায়গায় তাকে ঘায়েল করা যেতো। চরিত্র নিয়ে কথা বললে সে সহ্য করতে পারতো না। আমি সেটা ভালো করে জানতাম আর খোঁচাটা জায়গা মতোই দিতাম। কখনো কখনো সে অসম্ভব রেগে গিয়ে বলতো," আমি খারাপ, আমার চরিত্র খারাপ তাহলে কেন আমাকে রাখছ? আমার তো যাওয়ার পথ নাই, না হলে কবেই আমিই মুক্ত হইতাম। বাপের কাছে গেলেও তো আবার বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দিবে, সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না, আমি নিজে ইনকামের ব্যবস্থা করবো সেই পথটাও তো বন্ধ করে দিছ, পড়াশোনা বন্ধ করে দিছ।"

এর পরে সে কান্নায় লুটিয়ে পড়তো আর বলতো," ও আল্লাহ তুমি সব দেখতেছ, তুমি তো সব জান, আমাকে শান্তি দাও।"

আমি পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করতে করতে একটু যেন দয়া হতো তখন, তাকে জড়িয়ে ধরতাম, সে সর্বশক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো। পারতো না।

পরের দিন সকালে সে আবার তার রুটিন মাফিক কাজ করতো । আমি ভাবতাম সে সব কিছু ভুলে গেছে।

কয়েকদিন আমি খুব ভালো স্বামীর ভূমিকা পালন করতাম।

তাকে নিয়ে কোথাও গেলে সে আশপাশে তাকালেই আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করতাম সে কাকে দেখছে। আমি বলতামও কাকে খোঁজ?

সে তখন চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকতো। তাকে নিয়ে ঘুরতাম, খেতাম, কেনাকাটা করতাম আমি ভাবতাম এই সব কিছু তার প্রাপ্যর চাইতেও বেশি। খাওয়ার জন্য সে যা পছন্দ করতো সেটা দিলেও একশটা কথা শুনিয়ে আমার পছন্দেরটাই বেশিরভাগ সময় নিতাম, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই আমার মতামত প্রাধান্য পেতো।


সবাই ভাবতো তাকে আমি অসম্ভব সুখে রেখেছি, আমিও কিন্তু তাই ভাবতাম।


প্রথম সন্তান পেটে আসলে মাঝে মাঝে তার যত্ন নিতাম, খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুর, মন থেকে করার চাইতেও দেখানোর প্রবনতাই বেশি ছিলো- এইজন্য আবার বলতামও "এমন কেউ করে না, বুঝলে বৌকে মুখে তুলে কয়জন খাইয়ে দেয়, বৌয়ের বমি পরিষ্কার করে? আমার মতো স্বামী পাইছ, বিরাট কপাল তোমার?"

সে শুষ্ক ঠোঁটে মলিন হাসতো।

আমি ভাবতাম সে খুশি হয়েছে কিন্তু আমি ভুল ভাবতাম। সে বিদ্রুপের হাসি হাসতো, 'তোমার সন্তানের জন্য করছ, আমার জন্য কিছুই না' - এটাই সে ভাবতো।


তার হাতে দুই কিংবা তিন শত টাকার বেশি কখনো দিতাম না। আবার এটারও হিসেব নিতাম। 


বাসা একটু বেশি গোছানো দেখলেই জিজ্ঞেস করতাম "কে এসেছিলো? বল কে এসেছিলো? আমার অগোচরে কে বাসায় আসে?"

যে কোন পুরুষ মানুষকে জড়িয়েই তাকে কথা শোনাতাম।


সে তাকিয়ে থাকতো শুধু। সে আসলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো, আমার এই সব আচরণ দেখতে দেখতে।

বাসায় কোন আত্মীয় আসলে কিংবা আমরা কোথাও গেলে কোন পুরুষ ওর সম্পর্কে কোন প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ করলে আমার পিত্তি জ্বলে যেতো, অকারণে রাগ দেখাতাম, খারাপ আচরণ করতাম। এমনকি আমার আত্মীয় স্বজন সবাই যখন ওকে বেশি ভালোবাসতো ওর প্রশংসা করতো আমি সহ্য করতে পারতাম না।

শালি, কাজিন এদের- মোট কথা মেয়ে মহিলা দেখলেই আমার মনে অন্য রকম ভাব হতো, কথা বলতে ইচ্ছে হতো, তাই আমি আমার স্ত্রীর বেলায় ভাবতাম তারও আমার মতো এমন ইচ্ছে হয় । এইজন্যই কোন পুরুষের সাথে কথা বলা, সে যেই হোক আমার পছন্দ ছিলো না। আসলে মনে কূট তো আমার, তাই আমি তেমন ভেবেছি। ওকে যা ইচ্ছে তাই বলেছি, মুখে কিছুই আটকায়নি আমার। 


সে কেঁদেছে আর আমার তখন শান্তি লেগেছে।


আমি অফিসে পুরুষ কলিগদের চাইতে মহিলা কলিগের সাথেই বেশি সময় কাটাতাম। একটা সময় একজনের সাথে জড়িয়ে গেলাম। আমাকে সর্বস্বান্ত করে দিলো ঐ মেয়ে। ধার-দেনায় জড়িয়ে গেলাম। এমন একটা অবস্থা হলো যে, সংসার খরচও চালাতে পারি না। তাকে বলে বলে শ্বশুরের কাছ থেকে নিতে লাগলাম। সেটা অবশ্য সহজ ব্যাপার ছিলো না। ব্যবসা শুরু করেছিলাম সম্পূর্ণ লস হয়েছে এই সমস্যা দেখিয়েই কাজ হয়েছে। 


আত্মীয়, বন্ধু, দোকানদার, টিচার, রিকশাওয়ালা এমন কেউ বাদ নেই যাকে নিয়ে কটুক্তি বা নোংরা কথা শোনাইনি। ঐ যে চরিত্র নিয়ে বললেই শুধু কাজ হতো, এমনিতেও ও একটা মরা গাছে পরিণত হয়েছিলো সব সময়ের জন্য।


একবার ওর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো হয়তো, বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছিলো। 

আমি বললাম-

'কোথায় যাবে?'

সে বললো,'আল্লাহর এত বড় দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও আমার জন্য একটু জায়গা হবেই।'


আমি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বললাম,' যেখানে যাওয়ার যেতে পার কিন্তু আমার বাচ্চাকে নিতে পারবে না। আমার অগোচরে ওকে নিয়ে চলে গেলে খুঁজে বের করবো আর ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবো আর কখনো সন্তানের মুখ দেখতে দিবো না।'

সে বসে পড়লো ফ্লোরে।


আমি জানতাম সন্তান তার জান, ওকে ছেড়ে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। এটাই আমার কাছে আরেকটা হাতিয়ার হলো, ওকে ঘায়েল করার। 

এর পর থেকে আমার মনে ভয় হতো, সত্যিই যদি আমাকে ছেড়ে যদি চলে যায়! 

সে আমার ফ্যামেলির প্রতি খুব হেল্পফুল, কেয়ারিং তবুও আমি এমন করতাম। আমি এমন ব্যবহার করতে না চাইলেও হয়ে যেতো। 


 ওর বই পড়ার শখ ছিল। এনেও দিলাম অনেক কিন্তু ওকে পড়তে দেখলেই রাগে গা জ্বালা করতো।কিছু একটা বলে শুরু করে দিতাম। এর পরে সে পড়া ছেড়ে দিলো। একটু বসে থাকলে, শুয়ে থাকলে, টিভি দেখলে তখনও রাগ হতো আমার। এর পরে দেখলাম সে শুয়ে বসে না থেকে, কাজ না থাকলে রসুন বাছে, চাল বাছে। আমি ইচ্ছে করে ছোট ছোট দেশী রসুন আনতাম।

ও যদি কখনো এমনি বসে থাকতো বা শুয়ে থাকতো, টিভি দেখতো আমার পছন্দ হতো না। আমি চাইতাম সারাক্ষণ কাজ করুক, কেন আরাম করবে, আনন্দে থাকবে?কেন এমন করতাম জানিনা, করতে ভালো লাগতো।


আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম আমি রেগে গেলে সে আর আগের মতো আমাকে ভয় পায় না, এতে করে আমার আরো রাগ উঠতো। একদিন চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কত বড় সাহস! বললাম , কাঁটা চামচ দিয়ে চোখ গালিয়ে দেবো। সে বিদ্রুপের হাসি হেসে হেঁটে চলে গেলো। এক সময় সে আর আমাকে তোয়াক্কা করতো না। একদিন সে বলল,'আমার আর পাওয়ার কিংবা হারানোর কিছু নেই, আমার সাথে যাই কর আমার কিছুই যায় আসে না। নিজের মতো সবাইকে ভাবো তাই না? তোমার কীর্তিকলাপ যদি সবাইকে বলি তোমার মুখে থুথু দিবে।'


আমি থ হয়ে গেলাম।

জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেলাম আমি কি করেছি? ভাবনায় পড়লাম সে কি সব কিছু জানে? তাহলে এতদিন কিছু বলেনি কেন?

আসলে সে কিছুই জানতো না, সে হয়তো শুধু বুঝতে পারতো, তার আইকিউ আর সিক্সথ সেন্স খুব প্রখর।


সেদিন থেকে আমি একটু চুপসে গেলাম, মানুষের কাছে ভালো থাকাটা খুব জরুরী। সে তার নিজের মতো চলতে লাগলো। এটাও আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। সে তার সন্তানদের নিয়ে সুন্দর সময় কাটাচ্ছিলো, আমি বাসায় আসলেই যেন সবার মুখের হাসি উধাও। 

কিছু না করেও সে যেন আমাকে নীরবে শাস্তি দিচ্ছিলো। সব চাইতে বড় শাস্তি ছিলো যখন দেখলাম সন্তানরা আমাকে পছন্দ করে না, আমার থেকে ওরা অনেক দূরে। ওদেরকে অতিরিক্ত শাসন আর ওদের সামনে ওদের মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি, কাঁদিয়েছি এই সবের জন্যই ওরা হয়তো আমাকে পছন্দ করে না, ভালোবাসে না।

যে কোন বিষয়ে মায়ের সাথেই শুধু পরামর্শ করে। আমি যেন কেউ নই, কিছু নই! বিয়ে হলো ওদের, তাতেও তাদেরই সব সিদ্ধান্তে।


তবে কিছুটা হয়তো কিছু আছে এখনো- সে আমার মতো হয়ে আমার সাথে আমার মতো আচরণ করেনি, তেমনটা হলে আমার সাথে তার পার্থক্য তো থাকতো না। আমাকে খুঁজে না পেলে খুঁজতে বের হয়, লোক রেখেছে খেয়াল রাখার জন্য, ডাক্তার দেখায়। কিন্তু বুঝতে পারি সে কখনো আমাকে ভালোবাসেনি, ভালোবাসে না। আমার মতো মানুষকে ঘৃণা করা যায়, করুণা করা যায়, কখনো ভালোবাসা যায় না। একজীবন সে কাটিয়ে দিলো প্রিয়তমহীন, প্রেমহীন, ভালোবাসাহীন, মনোকষ্টে আর অশান্তিতে।

আমি হয়তো নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসি না এটাই ভাবতাম কিন্তু আমি আসলে নিজেকেও ভালোবাসতাম না এখনো ভালোবাসি না শুধু নিজের কর্তৃত্ব আর প্রাধান্য বজায় রাখতে চাইতাম। ভালোবাসতেই শিখিনি। জীবনকে সুন্দর করতে, সুখী করতে গেলে অন্যের ভালোবাসার প্রয়োজন আছে কিন্তু আমি যদি ভালোবাসা না দেই তাহলে পাবার আশা কিভাবে করতে পারি? ভালোবাসার সংজ্ঞাই হয়তো আমি জানি না।

আমি মাঝে মাঝেই সুযোগ বুঝে লাপাত্তা হয়ে যাই আমাকে খুঁজে বের করে ওরা, কখনো তাড়াতাড়ি পায়, কখনো দুইদিন পরে কখনো এক সপ্তাহ পরে খুঁজে পায়।

 তারা ভাবে আমি সব কিছু ভুলে যাই।

আমি…


কথা শেষ করার আগেই একজন বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়ালেন। মহিলাটি, বয়ষ্ক লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

– আর কত জ্বালাতন করবা তুমি? চল, বাসায় চল।


আমি তাঁদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমি লোকটার নামও জানি না। তাঁর শেষ কথাগুলো কি ছিলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে। অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছে করছে। আবার যদি দেখা হয় তখন জানতে চাইবো।


আমার বাচ্চাটা অন্যবাচ্চাদের সাথে প্লে গ্রাউন্ডে খেলছে। এখানে আমি প্রায়ই আসি। আজ একাই বসে ছিলাম। হঠাৎ ঐ বয়ষ্ক লোকটা এসে কথা বলা শুরু করলো। তাঁর জীবনের গল্প বলে গেলো। আমি কোন কথা না বলে শুধু শুনে গেছি। আমি কি লোকটাকে ঘৃণা করবো? ঐ মহিলার জন্য মন খারাপ করবো? নিশ্চিত লোকটা মানসিকভাবে অসুস্থ। অসুস্থ না হলে তার স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ করতে পারে ? এমন অসুস্থ লোক সমাজে কতই না ছড়িয়ে আছে, এর হিসেব কি আমরা জানি? আর এদের কবলে পড়ে কত নারীর সুন্দর জীবনের সুন্দর সময় নষ্ট হয়ে গেছে, যাচ্ছে বা যাবে। জীবন চলে যায়, অজানা থাকে কত শত মন খারাপের গল্প। 

(সমাপ্ত)


-ছোট_গল্প

-মন_খারাপের_গল্প

-ফাহমিদা_লাইজু


এমন আরও অনেক গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post