বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প
শিশু পার্ক থেকে বের হচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে মাম বলে কেউ ডাকছে শুনে আমি পেছন ফিরে দেখি তিন বছরের এক বাচ্চা ডাকছে। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলাম। কেমন একটা মাতৃত্বের অনুভব হচ্ছিল।
এক মহিলা আমার কোল থেকে বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে বললো,
– "দেখতে পাচ্ছেন না বাচ্চাটা কাঁদছে? আর আপনি ধরেই রেখেছেন, বাচ্চাটাকে আসতে দিচ্ছেন না?"
বললাম,
– "আজব তো বাচ্চাটা মাম মাম বলে কাঁদছিল?"
– "ও তাই? বাচ্চা ধরা বলে পুলিশে দিলে পুলিশের প্যাদানি খেলে মাম ডাক শুনে বাচ্চা আদর করা বের হয়ে যাবে!"
মহিলার এরকম বেপরোয়া কথায় প্রচুর রাগ হলো আমার। আমি এমন কিছু করিনি মহিলা আমার সাথে এরকম ব্যবহার করবে? তার উপর মহিলা আমার চেয়ে বয়সে ছোটই হবে।
আরেকজন মহিলা এগিয়ে এসে বললো,
– "সরি আপা কিছু মনে করবেন না, দেখতে পাচ্ছেন তো কতগুলো বাচ্চাকে সামলাতে হচ্ছে? আসলে বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে করতে অনেক সময় মেজাজ ঠিক থাকে না। কিন্তু এমনিতেই উনি আবার ভালো।এনিওয়ে আমি সিওসি সংস্থার একজন মেন্টর।"
– "সিওসি?"
– "হুম সিওসি একটা এতিমখানা।"
– "কিন্তু উনি যেভাবে বাচ্চা সামলাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে বাচ্চার মানসিক প্রভাব পড়বে?"
– "না না সেরকম কিছু না। বাচ্চাদের উনি ভালোও বাসেন।"
– "আচ্ছা?"
– "উনি আরও দশটা বাচ্চা সামলান, সবাই তাকে মা বলে ডাকে। যে বাচ্চাটা কাঁদছিল ওকে কয়েকদিন হলো আমাদের এখানে দিয়ে গেছে। বাচ্চাটার এডজাস্ট করতে সময় লাগছে।"
– "কয়েকদিন হলো দিয়ে গেছে? বাচ্চার বাবা মা আছে?"
– "হ্যাঁ বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে সেখানে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া হয়নি। বাচ্চার মা অন্যের বাড়ি কাজ করে, আর মহিলাটা অসুস্থ। বাচ্চার খরচ এবং মানুষ করতে হিমশিম খাচ্ছিল তাই এখানে রেখে গেছে।"
– "আহারে এদের বাচ্চা নেওয়ার দরকারটা কী? অযথা বাচ্চাকে কষ্ট দেওয়া। আপা আমি যদি বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে চাই দেওয়া হবে কি?"
– "সেক্ষেত্রে আপনাকে আমাদের সিওসি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে?"
– "ঠিক আছে আপনি ঠিকানা দিন। আমি আগামী কাল আসবো।"
.
.
.
আমি নাজমা হায়াত। একজন গৃহিণী। আমার স্বামী একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমার দুটো সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা কানাডা থেকে লেখাপড়া করছে। আর মেয়েটা ভার্সিটিতে পড়ে।
এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা প্রথম দেখায় প্রেমে পড়াকে যেমন বলে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইড, তেমনি তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটার প্রতি প্রথম দেখায় আমার মায়া জন্মে গেছে।
বাসায় আলোচনা করলে আমার স্বামী অবশ্য একটু আপত্তি জানালো। বললো, অযথা একটা উটকো ঝামেলা কেন টেনে আনছি?
কিন্তু আমার মেয়ে আমাকে সাপোর্ট করে বললো,
– "আম্মু ভালোই হবে। আমার একজন ছোট্ট সঙ্গী হলো। তুমি বাসায় একা থাকো তোমারও একজন সঙ্গী হলো।"
ওর বাবা আর কিছু বললো না।পরদিন আমি আর নায়লা সিওসি সংস্থায় গিয়ে অফিশিয়াল সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে বাচ্চাটাকে নিয়ে আসলাম।
নায়লা ওর নামের অক্ষরের সাথে মিলিয়ে বাচ্চাটার নাম দিল নিম্মি।
ভেবেছিলাম নিম্মি আমাদের খুব জ্বালাবে, কান্নাকাটি করবে। সেরকম কিছুই করছে না। বরং আমার সঙ্গ নায়লার সঙ্গ নিম্মি উপভোগ করে। রাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে শোয়। মাঝেমাঝে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ওর তাকানো দেখলে আমার মনটা জুড়িয়ে যায়।
আমি জানি না নিম্মির সাথে আমার কিসের কানেকশন। কোনো কানেকশনই হয়তো নেই। এই অ্যাটাসমেন্ট ন্যাচারাল।
নিম্মিকে পরিষ্কার করতে আমার খারাপ লাগে না। এটা সত্যি নায়লাকে আমি যেভাবে আনকন্ডিশনাল ভালোবাসি নিম্মিকেও তাই, এটা শিউর দিয়ে বলতে পারি।
এই ছোট বাচ্চাটা আমাকে এতো আনন্দ দেয় যে, মাঝেমাঝে আমি ওর কাছে ঋণী হয়ে যাই।
একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, নিম্মি গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছে। ওর বাবাও খুব একটা সামাজিক বা সভ্য বলা যায় না। কিন্তু নিম্মি খুব সভ্য, ক্লাসি, এবং মায়াদারী।
নায়লা তো ওকে চোখে হারায়। আর আমার স্বামীকে দেখে মাঝেমাঝে মনে হয় আমাদের থেকে বোধহয় উনিই বেশি ভালোবাসে। আসলে এটা নিম্মিরই ক্রেডিট। নিম্মি ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে। যে বাচ্চাটা এতো সুন্দর করে ডাকার চেষ্টা করে। কিছু খেতে লাগলে বলে, 'মাম কাবে, বাব কাবে, আপ্পু কাবে' ওর ছোট ছোট তোতলানো কথা আমাদের আনন্দ দেয়, ওর প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়।
নিম্মিকে আমি জন্ম না দিলেও ও আমার পরিবারের সাথে যেভাবে মিশে গিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই ও আমার আরেকটা মেয়ে।
সমাপ্ত