বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প | বাস্তব জীবন বড়ই কঠিন

 বাস্তব জীবনের স্ট্যাটাস

বাস্তব জীবনের স্ট্যাটাস

-বাবু আমায় ভোগ করো। শরী'রের জ্বা'লা মেটাও বাবু।


বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে।

হারিকেনের অল্প আলোয় আধভেজা সুরমাকে আজ অন্য রকম লাগছে। সুরমার ঢেউ খেলানো শরীরে  পরনের মলিন কাপড় ভেদ করে যেন ঠিকরে পড়ছে যৌবন অথচ সুরমার চোখে মুখে স্পষ্ট মিনতি, আমায় ভোগ করো বাবু।


টেবিলের ওপর জলের গ্লাস।

এক নিঃশ্বাসে সবটকু জল পান করে অল্প দামি সিগারেটের প্যাকেটে অবশিষ্ট যে সিগারেট আছে সেটি ধরিয়ে ধমকের সুরে সুরমাকে বললাম, সুরমা তুই আমার ঘরে এসেছিস কেন?


-ছেলেটার অসুখ করেছে গো বাবু। জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। আমার অইটুকুন ছেলের মুখে দুটো ভাত দিতে পারিনি গো। মা হয়েছি, বড় মায়া লাগে!


আমার পকেটে কিছু খুচরো পয়সা পরে আছে, এর বাইরে অবশিষ্ট নেই কিছুই। এক অসহায় জননী এসেছে নিঃস্ব রিক্ত এক যুবকের কাছে শরীর বেচতে, মন না জাগলে যার শরীর জাগে না কিছুতেই।


-বাবু গো! আমি তোমার কাছে আসতে চাইনি। আমাদের পাড়ার লম্পট হরিনাথ ছলেবলে তিনদিন ভোগ করে গেছে আমায়, একটা পয়সা দেই নি গো।

কি করে দিবে? ওর মেয়েটারও চোখ মুখ হলুদ হয়ে গেছে, হাসপাতালের ডাক্তাররা ফিরিয়ে দিয়েছে। পথ্য কেনার টাকা নাই গো বাবু হরিনাথের কাছে।


অস্পৃশ্য সুরমার পেটে জ্বালা, তার চেয়ে বড় জ্বালা সন্তানের পেটের জ্বালা। সতী সাধ্বী সেজে বসে থাকলে চলে? ওসব সাজ তো ভদ্দরলোকের ঘরের মেয়েদেরকে মানায়  যাদের ভরপেট খাবারের ভাবনা নেই।


ঘরের মেঝেতে কাগজের ঠোঙায় অল্পকিছু চাল অবশিষ্ট ছিল, আমি দেখিয়ে দিলাম সুরমাকে। সুরমা তাই নিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। 

গরীবের মাথা উচু হয় তবু কোনো কোনো দিন, অস্পৃশ্য হরিজন, মেথর, ডোম, চন্ডালদের মাথা নিচুই থাকে চিরকাল।


ভবঘুরে মানুষ আমি।

সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও রাতের বেলা মাথা গোঁজবার মতন একটুকু আশ্রয় আমার চাই। এদিকে মেথরপট্টির সাথেই ভদ্রলোকের থাকার আবাস। আবাস মানে দু চালা টিনের ঘরের সারি,তার মধ্যে থেকে আমিও একটি ঘর ভাড়া নিয়ে অল্প আয়ের মানুষজনের সাথে থাকি। 


মেথরপট্টির সাথে তথাকথিত এই ভদ্র পাড়ার ছোট্ট একটা প্রাচীর আছে দিনের বেলায়, তা কেবল লোক দেখাতে হয় বলেই। রাতের বেলা এ দুই মিলে আলাদা কোন পল্লী নয়।


সন্ধ্যে হলেই মেথরপট্টির পুরুষেরা সারা দিনের হিসেব চুকিয়ে সকলে মিলে গোল হয়ে মদ নিয়ে বসে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হুঁশ থাকে না কারো। তখন এই মেথরপট্টির যুবতী বউদের কারো কারো ঘরে অল্প আয়ের মানুষদের শুরু হয় আনাগোনা কিংবা কেউ কেউ খদ্দের না পেয়ে বেরিয়ে পরে দুটো পয়সার খোঁজে, তবুও শরীর আছে যতদিন ততদিনই। মেথরপাড়ার মেয়েদের শরীরে যৌবন বেশিদিন থাকে না, অনাহারে জীর্ণ শরীরে বার্ধক্য হানা দেয় দ্রুত।


আমার ঘরে সচরাচর কেউ আসে না কিন্তু আজ সুরমা এসেছে বড় বিপদে পড়ে। সুরমার স্বামী নাতু এবেলা মদ খেয়ে পড়ে আছে কোথাও, দিনের বেলা আফিম খায়। তবু নাতুর বিশেষ কোন দোষ আমি দেখি না, হরিজনরা বেকার হয়ে পড়ছে। 


দেশে যা হোক একটা চাকুরীর বড় অভাব। মিউনিসিপ্যালিটি অফিস থেকে হরিজনদের কাজ নিয়ে নিচ্ছে ভদ্দরলোকের ছেলেরা। যে কাজ ওরা বংশপরম্পরায় করেছে;ওদের পূর্বপুরুষ, তাদের পূর্বপুরষরা এই শহরের নর্দমা, ড্রেন, জলাশয় পরিষ্কার করে গেছে সেই কাজেও আজকাল  ভাগ বসেছে।


না! হরিজনরা মেনে নেয়নি সহজে। ওরা দল বেঁধে মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে ভিড় করেছে ওদের পূর্বপুরুষদের পেশায় ওদের শতভাগ নিয়োগের দাবিতে।

সামনে জাতীয় নির্বাচন, মেয়র সাহেব তদবিরে ব্যস্ত।

মিউনিসিপ্যালিটির সেক্রেটারি সাহেবের বউ পোয়াতি, ডাক্তার বউকে সময় দিতে বলেছে এ বিশেষ সময়ে।

অস্পৃশ্য হরিজনদের কথা কে শোনে?


নাতুদের কাজের বড় অভাব! যে কেউ ওদের কাজ দিতে চায় না, ছোঁয়াছুঁয়িতে বড় আপত্তি এই শহুরে বাবুদের। ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য নাতুরা আফিম খেয়ে এখানে সেখানে পড়ে থাকে, দিন অতিবাহিত করে। পেটের জ্বালায়, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সুরমারা রাতের আঁধারে বেছে নেয় বেশ্যাবৃত্তি।


পরদিন অনেক বেলা নাগাদ ঘুম ভাঙে আমার। ঘর থেকে বেরিয়ে গলির মুখে বিষ্ণুর দোকানে গিয়ে সিগারেট ধরাই, তেতো বিশ্রী স্বাদে গুলিয়ে যায় শরীর।

বিস্বাদ লাগে সিগারেট, জ্বর হওয়ার লক্ষণ। কিন্তু জ্বর তো কোন রোগ নয়, রোগের উপসর্গ।


সুরমার বছর চারেকের ছেলেটার কথা মনে পড়ে। মেথরপট্টির দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি হরিনাথ ধীরেনের বউর সাথে অশ্লীল রসিকতায় মেতে রয়েছে অথচ ওর মেয়ের জন্ডিস,লিভারের অবস্থা ভাল নয়। হরিনাথ মদ আফিম আর নারী সম্ভোগে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চায় সাংসারিক অভাব অনটন থেকে, এদেরকে কে বোঝাবে সংসারে বুক দিয়ে রুখে দাঁড়াতে হয় বিপদে।


সুরমার ছেলের অবস্থা ভাল নয়। গত সাতদিনে জ্বর নামেনি, গা পুড়ে যাচ্ছে। দু মুঠো ভাতের জোগান নেই, পথ্যের প্রত্যাশা যেন এখানে তামাশা। নাতু কোথায় আফিম খেয়ে পড়ে আছে কে জানে। হাতে কিছু টাকা এলে এরা চাল কেনার বদলে মদ কিনে, আফিম কিনে।

সুরমা সাত পাঁচ না ভেবেই আমার পা ধরে ফেললো শক্ত করে, বাবুগো আমার বাপধনকে বাঁচাও। আমার মানিককে বাঁচাও, আমার যতীনকে বাঁচাও। বাবু পায়ে পড়ি তোমার!


অবহেলিত, বঞ্চিত, রোগগ্রস্ত যে জীর্ণ শিশুটি পড়ে আছে মেঝেতে,পৃথিবীতে এই শিশুটিও বাঁচার সমান অধিকার নিয়ে এসেছিলো। কারা ছিনিয়ে নিয়েছে এই অধিকার? কারা এদেরকে অস্পৃশ্য বানিয়েছে, এই দেবশিশুকেও?


আমার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচানো গেল না যতীনকে। সরকারী  হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে দুদিন পর যতীন ছেড়ে গেলো এই নিষ্ঠুর পৃথিবী, দেখে গেলো মানুষ হলো পৃথিবীর সব চেয়ে চাতুর পশু।


সুরমা নির্বিকার বসে ছিল যতীনের মৃতদেহের পাশে।

আমি বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। এই শহরে বিষাদ ছেয়ে গেছে, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, ছাড়তে হবে এই শহর।


শহর ছাড়ার সময় শুনতে পেলাম মেয়র সাহেব জাতীয় নির্বাচনে নিজ দলের কাছে থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন সেক্রেটারি সাহেব ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরা এদের অভিনন্দন জানাচ্ছে, অভিনন্দন তোমাদর।


গল্প: অভিনন্দন

মঈনুল সানু।


বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post