আমার প্রতি তোমার অবহেলা
এই বাড়িতে যখন প্রথম বউ হয়ে আসি, দুইজন মানুষকে আমার একদমই সহ্য হতো না তারমধ্যে একজন আমার স্বামী, অন্যজন আমার শাশুড়ী। আর এই বাড়ির অন্য তিন বউকে আমার মানুষই মনে হতো না। সত্যি বলতে কি, তাদের দেখে আমার মায়া হতো। আমি এই বাড়ির সর্বশেষ বউ। আমার বড় তিন জা, এদের সবার স্বামীই প্রবাসী। এখনো এই ভাইদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। শুধু আমার সাহেবই দেশে বিজনেস করেন। সবার ছোট ছেলে হওয়াতে আমার শাশুড়ী উনাকে নিজের থেকে দূরে রাখতে চাননি। আমার স্বামীর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমার শ্বশুর দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। তখন থেকেই আমার শাশুড়ী একলা হাতে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বড় করে তোলেন। সব বাচ্চারাই ১৫ বছরের কম বয়সী ছিল। শত কষ্টের পরও এই অপূর্ব সুন্দরী বিধবা মহিলাটি সন্তানদের ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়েছেন। এমনকি দুই মেয়ে সন্তাদেরও পিছিয়ে রাখেননি।
উনার ব্যপারে জেনে প্রথমেই উনার প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে এসেছিল। যখন এই বাড়িতে আসি সেই শ্রদ্ধা ঘৃণায় রুপ নিতে সময় নেয়নি। মনে হতো কোন মা এত কঠোর কীভাবে হতে পারে?!
একমাত্র আমার সাহেবই উচ্চ শিক্ষিত। এবং দেশে বিজনেস করেন। ভাইদের টাকায় বিজনেস করে দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এখন উনি বিজনেসের ব্যপারে আবেগহীন পাক্কা একজন ব্যবসায়ী।
তবে এদের মধ্যে একটা জিনিস বেশ ভাল লাগে, এরা ভাইয়ে ভাইয়ে প্রচন্ড মিল। একে অপরকে নিস্বার্থভাবে ভালবাসে। একে অপরের মতামতকে খুবই মূল্যায়ন করে। সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে আমার শাশুড়ীর মতামতকে। বলা যায় উনার কথার উপর একচুল পরিমাণও নিজের মত প্রকাশ করেন না। উনি সাপকে ব্যাঙ বললে ওরাও বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে! আর এই জিনিসটাই আমার একদমই অসহ্যের।
উনাদের বাড়িটা উপজেলা ভিত্তিক যে শহরগুলো হয় না? প্রায়ই শহরের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু আশেপাশের গ্রামীণ পরিবেশ শহরটাকে অনেক বেশি সুন্দর করে তোলেছে। এই বাড়িটা আমার কাছে আরেক অদ্ভুত মনে হয়! বিশাল বড় বাউন্ডারি! কী নেই এতে, মাঝারি সাইজের পুকুর, পুকুরের চারপাশে বেশ উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল। পুকুরের পাড়ে নানা রকমের ফলের গাছ, সেখানে আপেল, আঙুর, কমলা, ডালিম, সফেদা থেকে শুরু করে নানা দেশি-বিদেশি ফলে সবসময় পূর্ণ। আর এই পুকুরের বাউন্ডারিতে শুধমাত্র বাগান পরিচর্যাকারী ছাড়া বাইরের সব পুরুষ সদস্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই এক আজব বিষয়!
তবে সব বউরা যখন খুশি পুকুরে যেতে পারবে। উঠানের এককোণেয় লোহার বড় এক দোলনা, যেখানে অনায়াসে দুইজন মানুষ আরাম করে শুইতে পারবে। কয়েকটা সাইকেল, প্রথম দেখেই আমার মনে হয়েছিল এখানে বড় সাইকেল চালানোর মত কেউ নেই তবে এত সাইকেল কেন?
আমার খুব বিরক্ত লাগে, শহরে নিজেদের বিশাল বড় বাড়ি থাকার পরও এরা কেন গ্রামে পরে থাকে। তবে শহরের সব সুযোগ সুবিধাও ভোগ করে। নিজেদের গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না। দুই বাড়িই খুব আধুনিকভাবেই তৈরি করেছে। শুনেছি বড় ভাইরা বিদেশের সিস্টেমেই সব কিছু করেছেন।
আর আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়া অবস্থায়ই বাবা আমার পড়ালেখার, আমার মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে এই বাড়িতে আমার বিয়ে ঠিক করেন। আমার সাহেবের সাথে বাবার অনেক আগে থেকেই ভাল সম্পর্ক। ব্যবসার দিক দিয়েই এদের পরিচয়।
এই বাড়িতে আসার পর থেকেই শুধু বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হতো। কেন বাবা এমন করলেন? এমনিতেই বাবা খুব শান্ত মানুষ। মায়ের কথার বাইরে কথা বলেন না। কিন্তু আমার বিয়ের ব্যপারে বাবা এত দৃঢ় কীভাবে হলেন বুঝে আসে না। মায়ের কোন কথা শুনেননি। এমনকি মাকে কয়েকবার এমনভাবে বকা দিয়েছেন আমার গরম মেজাজের মা চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো এই নতুন রুপটি মাকে বেশ অবাক করেছিল। যেমন আমরা সবাইও অবাক হয়েছিলাম।
এই বাড়ির তিন বউয়ের পাঁচটা সন্তান। দুই বছরের ছোট বাচ্চাটিসহ বাড়ির সবাই ফজরের আজানের সাথেসাথেই ঘুম থেকে জেগে যায়। পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চাটিরও নামাজ পড়তেই হবে কোরান শেখা শুরু করেনি কিন্তু মায়ের সাথে মুখে মুখে দোয়া পড়তেই হবে। এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবারের পরপরই সবার কেমনে ঘুম আসে আমি বুঝতে পারি না। আমার খুব রাগ হয়, আমার সারারাত ঘুম আসে না, আমার ঘুম আসার টাইমেই এরা জেগে যায়। আমার সারাদিন খুবই বিরক্তিতে দিন কাটতো। দুপুরে একটু ঘুমুতে পারতাম তাও দেড়/দুই ঘণ্টা আসরের আজানের সাথেসাথে সবাই উঠে যাবে। উফ্! এত কষ্ট অসহ্য। আমার জা'দের দেখলে মনে হয় এরা আমার শাশুড়ীর ভয়ে এমন; না কি এরা স্বাভাবগতপভাবেই এমন৷ বাড়ির যে কোন কাজ এরা কার আগে কে করবে ভেবে পায় না। বুয়াও আছে, আবার পার্মানেন্ট কাজের মেয়েও আছে। তাও শাশুড়ী গোসল করার পর এরা কার আগে কে শাশুড়ীর কাপড় ধুয়ে দিবে প্রতিযোগিতা করে।
আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আল্লাহ এদের হিংসা, ঈর্ষা ছাড়াই বোধহয় দুনিয়েতে পাঠিয়েছেন।
আর আমার স্বামী, সে রুমের ভেতর খুব খুব ভাল একজন স্বামী। খুব হেল্পফুল, কেয়ারিং, লাভিং, আমাকে ছোট বাচ্চাদের মত স্নেহ করেন, ভালোবাসেন, বুকের গভীরে আগলে রাখতে চান।সবসময় একটা কথা বলেন, প্লীজ সুমাইয়া, মায়ের অবাধ্য হয়ও না। মা আমাদের বহু কষ্টে বড় করেছেন। কিন্তু রুমের বাইরে আসলেই সে অন্য মানুষ। আমার রাগ হতো কেন সে আমার সাপোর্টে কিছু বলতে পারে না? আমি বাবার বাড়ি যেতে চাই! কিন্তু না, নির্দিষ্ট সময় না হলে যেতে পারব না। একবারে একটা বউ বাবার বাড়ি যেতে পারবে। দশ দিন থেকে আসার পর অন্য বউ যেতে পারবে সিরিয়াল করে। কী অদ্ভুদ!
কারো যেতে ইচ্ছে হলেও যেতে পারবে না।
বিয়ের এক মাসের মাথায় সেদিন তো আমার আশ্চর্যের চরম সীমা পার হয়ে গেছে! রাতে নামাজের পর বাচ্চারা যখন ঘুমিয়ে গেল শাশুড়ী বললেন,
--অহ বউ, তোমরা সবাই একটু সাজুগুজু করতো, সবাই শাড়ি পর।
দেখলাম, সব বউ খুশি মনেই সাজুগুজু করতে চলে গেল। আমার আশ্চর্যের ঠেলা সামলাতে সময় লাগছিল বলে দেরী হচ্ছিলো শাশুড়ী আবার বললেন, মা'রে আমার ইয়াসির বাসায় আছে তাই সাজতে বেলছিলাম, যদি তোমার সাজতে ইচ্ছে না করে না সাজ সমস্যা নেই।
আমি এমনিতেই সাজুগুজু করতে ভালোবাসি। কিন্তু এই মহিলার কথার বিরুধীতা করার জন্যই আমি না সেজে সোজা রুমে চলে গেলাম।
একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না, আমার না হয় ইয়াসির বাসায় আছে বলেই সাজতে বললেন কিন্তু সব ভাবীদের কেন সাজতে হবে!? যার উত্তর জানলাম পরেরদিন ওরা সবাই রাতে জামাইদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। এর পরে প্রায়ই দেখতাম ওরা রাতে সাজতেছে।
সেদিন আমার বড় জায়ের ছেলেটা প্রি-পোজিশনের ব্যবহারে কিছু ভুল এক্সাম্পল পড়ছিলো, আমি পাশেই ছিলাম আমি তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে কী এক মহা বিপদ ডেকে এনেছি!
শাশুড়ী বললেন,
- সেমাইয়া আজ থেকে তুমিই টাইম করে এদের তিনজনকে পড়াবে৷
উফ! কী যে অসহ্য লাগছিলো কথাগুলো! উনার সামনে তো কিছুই বলতে পারিনি কিন্তু রুমে গিয়ে ইয়াসিরের সাথে অনেক ঝগড়া করি। ওকে এত এত কথা শুনিয়েছি, সে পালটা একটা কথাও বলেনি। আমার এত এত তীর্যক কথার বিনিময়ে আমার আরো ভালোভাসাই ভরিয়া দিয়ে একটা কথাই বলেছিল,
-- সুমাইয়া মায়ের কথা শুনে দেখ না, হয়তো তোমার ভালই লাগবে।
: আমার ভালো লাগবে না। তোমার সব ভাবিদের উপর যেমন চাপিয়ে দিয়েছে সবকিছু তেমনি আমাকেও তাই করতে বলছে।
--তুমি ভুল বুঝছ, মায়ের দেওয়া দায়িত্ব পালনে ভাবিদের কখনো বিরক্ত হতে দেখেছ? তারা বরং খুব হাসি মুখেই সব দায়িত্ব পালন করে।
তা ঠিক তারা কখনো বিরক্ত হন না। এমন নয় যে খুশি হওয়ার ভান ধরে। সত্যিকারভাবে খুশি হয়েই ওরা শাশুড়ীর প্রতি দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ইয়াসির কীভাবে জানলো? সে তো কখনো ভাবীদের চেহারাও দেখেনি!
এই বাড়ির আরেকটা খুবই আজব নিয়ম, একটা মাত্র পুরুষ মানুষ কিন্তু তার সামনে কেউ যায় না শুধু শাশুড়ী ছাড়া। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাই আড়ালে চলে যায়। অবশ্য এই নিয়মটা আমার ভালই লাগে। যদি ইয়াসির ওর সুন্দরী ভাবীদের
সাথে ঠাট্টা -মসকরা করতো আমার ভাল লাগতো না।
যাক, শুধুমাত্র ইয়াসিরের কথা রাখার জন্য বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলাম। তিনজনকে তিন টাইমে পড়াই। আগের টিচারকে বিধায় করা হয়েছে। প্রথম দিকে ওদের পড়াতে ভালো না লাগলেও আস্তে আস্তে বেশ ভাল লাগতো। বাচ্চা৷ তিনটাই অতি ব্রিলিয়ান্ট। বাচ্চাদের তিন টাইম পড়াইয়ে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে যেতাম ঘরের কাজ করতে কিছুতেই মন চাইত না। তাও শাশুড়ী ভয়ে কাজ করতে গেলাম। এমনিতেই বড় জা, আমার কাছ থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে বললো,
-- তোমার কোন কাজ করতে হবে না, এটা মায়ের আদেশ।
সাথে মা রুম থেকে বলে উঠলো,
: হ্যা রে বউ, তোমার কাজের চিন্তা করতে হবে না। তুমি মানুষ না কি। কত কষ্ট কর আমার নাতিদের জন্য। আবার কাজও। না মা আমি অতটাও খারাপ নই।
মনে হলো প্রথমবারই এই মহিলাকে একটু ভাল মনে হলো। যাক কাজ থেকে তো মুক্তি পেলাম। তারউপর এমন ট্রিট পেতাম নিজেকে রাজকুমারী মনে হতো। যেহেতু কাজ করতে হয় না নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি এদের পড়াতেও আরো একটু মনোযোগী হলাম। পড়ার কিছুদিন পর, সম্ভবত এক মাস পর আমি এত বেশি অবাক হয়েছি আমি কয়েকটা হার্টবিট বোধহয় মিস করে গেলাম। আমার শাশুড়ী আমার হাতে আট হাজার টাকাসহ এক খাম তুলে দিয়ে বললেন,
: আগের মাস্টারকে সাত হাজার দিতাম তোমাকে একহাজার বাড়িয়ে দিলাম কারণ তুমি আমার নাতিদের অনেক আদর করে পড়াও। তাছাড়া খুব কষ্ট করে নিজের পড়ার পাশাপাশি এদের পড়াও।
আমি কখনো ভাবিনি এদের পড়াইয়ে টাকা নিব। আমি বাচ্চাদের ভালোবাসি। ওরা যখন ছোট আম্মু করে করে পাগল করে তুলে আমার বেশ ভাল লাগে। শাশুড়ীকে বললাম
: না মা, আমার টাকা লাগবে না, আপনার ছেলে আমাকে কোন কিছুর কমতি রাখেনি, না চাইতেই আমার হাতখরচ দিয়ে দেয়।
--রাখ বউ মা, এটা তোমার কষ্টের ফসল আর তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
না নিলে আমি কষ্ট পাব।
না চাইতেও নিলাম। কিন্তু এক অন্যরকম তৃপ্তি পেলাম। জীবনে প্রথম নিজের উপার্জনের টাকা।
মনে আসলো, উনি বোধহয় সব বউদেরই কোন না কোন ভাবে এভাবে পুরুস্কৃত করেন। হয়তো তাই উনার বউরা কোন কিছুতে বিরক্ত হয় না।
এর কিছুদিন পরেই আমার পরীক্ষা, আমি ইয়াসিরকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেলাম। এত এত আনন্দ লাগছিলো। অনেকদিন পরেই বাবার বাড়িতে একটু আনন্দ করে বেশিদিন থাকতে পারবো। শাশুড়ী বলে দিয়েছেন যতদিন আমার পরীক্ষা শেষ না হবে ইয়াসির যেন আমার বাবার বাড়িতেই থাকে। আমার খুশি কে দেখে! এত এত খুশি হয়েছি ইয়াহু বলে এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আওয়াজটা এত বড় হয়ে গিয়েছিলো ইয়াসির আমার মুখটাই চেপে ধরলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চুপ হয়ে গেলাম।
গল্প: _আমার_শাশুড়ী
পর্ব_১ম
_আমার_শাশুড়ী
পর্ব------০২
Nilofa Nilo(উম্মে জাবির)
আমি প্রায় দেড় মাস পর বাবার বাড়িতে রাত জেগে সকালে একটু ঘুমানোর সুযোগ পেলাম। খুব খুশি হয়ে বসে ছিলাম সারা রাত পড়বো আর ভোরে ঘুমাবো। কিন্তু না কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে এশারের নামাজের কিছুক্ষণ পরই হাই আসতে লাগলো। ইয়াসির অলরেডি বিছানা গুছানো শুরু করে দিয়েছে। খানিকটা ব্যঙ্গ করেই বললাম,
--এই তুমি এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাচ্ছ কেন? এখানে তো আর তোমার মা নেই, ভোরে উঠে নামাজ না পড়লে তোমাকে বকবে!
: প্রথমত নামাজ আমি মায়ের জন্য পড়ি না। হ্যা, মায়ের শাসন আমাকে নামাজে অভ্যস্ত হতে সহায়তা করেছে! আমি অধিকাংশ সময়ই শহরে থাকি সেখানেও আমি নামাজ কাজা করি না। সোমবার, বৃহস্পতিবার আর আরবি মাসের মাঝখানের সুন্নত রোজাগুলোও আমার বা আমাদের কাছে ফরজ রোজার মতো হয়ে গেছে।
-- বাবরে বাব! এত এত রোজা। কেমনে পার?
: কিছুটা অভ্যাসবশত হলেও মোটামোটি সুন্নতকে ভালোবেসেই রাখা।
--আসলে তোমার মা খুবই কঠোর।
ইয়াসির জাস্ট মুচকি হেসে বললেন,
: এত তাড়াতাড়ি নির্ণয় করে ফেললে? কিছুটা সময় না হয় যাক।
আমি এই ব্যপারে আর কথা বাড়ালাম না, উনি শাশুড়ী, গুরুজন। আমার পরিবার থেকে আমি এই শিক্ষা পাইনি। আমিও শুয়ে পড়লাম। তবে খুব ভাল লাগছে, অনেকদিন পর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো। ভোরে উঠার টেনশন নেই। ইয়াসিরের সাথে এটা সেটা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে যায় কিন্তু তাও কীভাবে যেন ফযরের আযানের সাথে সাথে ঘুমটা ভেঙেই যায়। কিন্তু ঘুমের জন্য চোখ খুলতে পারছি না৷ লক্ষ্য করলাম ইয়াসির বিছানায় নেই। আদা ঘুম, আদা জাগানোর মধ্যেই বললাম, কেমনে পারে?
যখন পরিপূর্ণ ঘুম ভাঙল দেখলাম ইয়াসির কোরান তেলওয়াত করছে।
খানিক রাগ দেখিয়ে বললাম,
--আমাকে ডাকনি কেন?
: ডাকলে তুমি উঠতে?
--না উঠলে পানি ঢেলে দিতে!
: না, আমি জোর করে তোমার কাছে কিছুই আশা করি না।
একটু আওয়াজ নিচু করে খানিকটা বিড়বিড় করে বললাম, তাই তো এখনো স্বামীর অধিকারটুকুও আদায় কর নি। নিজের বিয়ে করা বউ থেকেও দূরত্ব বজায় রাখ। একই বিছানায় থেকেও কত দুরত্ব।
আমি জানি সে শুনেছে তাও না শুনার ভান করে বললো,
: তুমি যা আদায় করবে ভালোবেসেই। মায়ের ভয়ে, অন্য কারণে নয়। আমার বিশ্বাস তুমি আমার রঙেই রাঙিয়ে যাবে যেটা আল্লাহর রঙ, ইসলামের রঙ।
আমি কথা না বাড়িয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম।
আমরা দুই ভাই বোনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত বিশেষ করে ফজরের নামাজের অভ্যাস না হলেও মা ফজরের আগেই ঘুম থেকে উঠে যায়। এশরাকের সালাত আদায় করে সকালের নাস্তা রেডি করে।
ইয়াসিরসহ বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে দেখতাম মা ফজরের সালাত আদায় করেই নাস্তা রেডি করছে। হয়তো ইয়াসির ভোরে উঠে বলেই।
ওমা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম ইয়াসির রুমে খাবার নিয়ে এসেছে। বললো,
: হা কর আমি খাইয়ে দিচ্ছি তুমি পড়া শুরু কর।
কাল পরীক্ষা রাতেও পড়া হয়নি।
কিছুটা অবাক হলেও বেশ ভালো লাগছে। বিয়ের আগে নিজের হাতে কয়বার খাবার খেয়েছি বোধহয় গুণে দিতে পারবো। হয় মা নয়তো বাবাই খাইয়ে দিত। একমাত্র এবং বড় মেয়ে হওয়াতে বাবা মায়ের সব আদর পুরোপুরি আমার ভাগেই ছিল। শ্বশুর বাড়িতে তো সবার সাথেই খেতে হয়েছে কিন্তু বাবার বাড়িতে প্রথমবারের মতো ইয়াসিরের এই স্নেহময়ী রুপ দেখে চোখের কোণায় পানি জমা হয়ে গেল। বাবা আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। মা সবসময় আক্ষেপ করে বলতো, "জানি না বিয়ের পরে তোকে এত যত্ন করে কে ভালোবাসবে? এখানে বাবার হাতে এত আদরে বড় হচ্ছিস না জানি শ্বশুর বাড়ি কেমন হয়?" মনের অজান্তেই অস্ফুটে বেরিয়ে এলো,
" বাবার রাজকন্যাটি এখন স্বামীর রাণী"
ইয়াসির কথাটি খেয়াল করে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
-- হয়েছে এত ব্যখ্যা দাড় করাতে হবে না পড়তে বস।
পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে আসার সময় আবার সেই স্বাধীনচেতা বিন্দাস জিন্দেগী উপভোগ করার জন্য গাড়িতে না গিয়ে ইয়াসিরকে বলে রিক্সায় বসলাম। রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। অনেক দিন পর বেশ মজা লাগছিল, ওই বাড়ি থেকে কয়েকবার দাওয়াত খেতে গিয়েছি, ওরে ইয়া বড় এক জোব্বা মতন বোরখা, পায়ে মোজা দেখতে পুরাই খালাম্মা। ইয়াক!
আমি তো অশালীন পোশাক পরি না। হিজাব, থ্রী পিস এতে কী প্রব্লেম বুঝি না। আসার সময় ইয়াসিরকে বলেই দিয়েছি,
-- আমি ওই জোব্বা পরতে পারবো না। প্লীজ জোর কর না৷ কথা রাখতে পারবো না।
ওর চেহারা খানিকটা মলিন হয়েছিল কিন্তু তা মুহুর্তের আবার মুচকি হাসি দিয়ে চুপ হয়ে থাকলো। সেদিন ওকে নিয়ে বেশ কয়েকটি সেলফি তুললাম। জামাইকে নিয়ে প্রথম ফবতে পিক আপলোড করবো বলে। এর আগেও বেশ কয়েকবার দিতে চেয়েও দেওয়া হয়নি। ওকে নিয়ে ছবি দিয়ে বান্ধবীদের কাছে বেশ ভাব দেখাতে পারবো। সে এতই আকর্ষণীয়, সুন্দর, সুঠাম দেহের অধিকারী। আর্মিদের মতো জিম করা পেটানো শরীর। ওর সাথে মানাতে হলে আমাকেও স্লিম থাকতে হবে যদিও ওদের বাড়ির তিন বউকে দেখলে এখনো অবিবাহিতই মনে হয়। এত সুন্দর ফিগার। খোঁজে খোঁজে সুন্দরীদেরকেই বাড়ির বউ করে এনেছে।
বাসায় এসে মোবাইল নিয়ে পিক আপলোড দিতে যাবো, সে কীভাবে যেন বুঝতে পেরে ঠিক সেই মুহুর্তেই বললো,
: সুমু কিছু কথা বলি? একটু মন দিয়ে শুনবে প্লীজ, তারপর না হয় মোবাইলের কাজ শেষ করিও।
-- হুম বল।
: আগে একটা হাদীস বলি?
রাসুল (স:) বলেন,
তিন শ্রেণীর মানুষের উপর জান্নাত হারাম করা হয়েছে:
১, যারা কোন প্রকার নেশাদ্রব্য পান বা গ্রহণ করে।
২, মাতাপিতার অবাধ্য ব্যক্তি।
৩, দাইউস। ঐ দাইউস ব্যক্তি যে তার পরিবারে পর্দা প্রথা চালু রাখেনি। পরিবারের সদস্য বেপর্দা চলাফেরায় বাধাও প্রদান করেনি।(মুসনাদে আহমাদ: ২/৬৯)
(৩)দাইয়ুস সম্পর্কে রাসুল (স:) বলেছেন,“ঐ ব্যক্তিকে দাইয়ুস বলা হয় যে তার পরিবারের অশ্লীলতা ও কুকর্মকে মেনে নেয়।” (মুসনাদ আহমদ, নাসাঈ)
(৪)এ ব্যক্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “দাইয়ুস কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (নাসায়ীঃ ২৫৬২, মিশকাতঃ ৩৬৫৫)
-- আমি কুকর্ম বা অশ্লীলতা কি করছি?
প্রচণ্ড রাগের সাথে বললাম ।
: একটু অপেক্ষা কর, বলতেছি,
রাসুল (স:) বলেন,
যে মহিলা সাজসজ্জা করে, টিপ পরে, লিপস্টিক মেখে ,সুগন্ধী মেখে বাইরে বের হয়, বেগানা পুরুষকে আকর্ষণ করে ঐ মহিলা জেনাকারি যদিও সে এখনো জিনা করেনি (সহিহুল জামে-২৭০১, তিরমিয, আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ)।
প্রচণ্ড রাগের মাথায় বললাম,
-- তো, তুমি আমাকে জেনাকারি বলছো, তাই তো?
: আমি তো কিছুই বলিনি।
আমাকে পাশে বসিয়ে, অনেকটা জড়িয়ে ধরেই বললো, শোন সুমু,
: ধর, তুমি আমাদের ছবিটা আপলোড দিলে। এই যে আমার সুন্দরী বউটা, সাজগোছ করে তোমাকে আরো সুন্দর লাগছে। তোমাকে দেখে কত পুরুষ চোখের তৃপ্তি মেটাবে। কতজনে তোমাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করবে হয়তো কেউ কেউ কমেন্টে এসেও লিখে যাবে। এগুলো শুনতে তোমার নিশ্চয় ভালো লাগবে না। অথচ তুমিই তাদের সেই সুযোগ করে দিচ্ছ। নামাজ, রোজা না করলে আমরা একাই গুনাহগার হচ্ছি অথচ তুমি বেপর্দায় চললে তোমার পরিবারের কর্তা ব্যক্তিরা সহ আরো কতশত জনে গুনাহগার হবে তার কোন ইয়াত্তা নেই।
আমি, তোমার বাবা হবো দাইউসের গুনায় গুনাহগার। আর মানুষের হায়াত মউতের কোন ভরসা নেই, এই ছবি গুলা রেখেই যদি মরে যাই তাহলে যতদিন তোমার আইডি থাকবে গুনাহ হতে থাকবে।
--আরে আমি মারা গেলে তুমি আইডি ডিয়েক্টিব করে দিও। পাসওয়ার্ড দিয়ে দিব।(বিরক্ত হয়েই বললাম।)
: কিন্তু সুন্দর ছবি তাই কেউ যদি তোমার ছবি তোমার অজান্তেই প্রপিক হিসেবে ইউজ করে।
তাহলে তো আর ডিলিটেরও সুযোগ থাকবে না।
আমাদের সওয়াবের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু গুনাহের পথ হয়তো কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে। ভাবতে পার কী ভয়াবহ ব্যপার!
-- আরে বাবা, গুনাহ হলে আমার হবে তোমার কি?
: আমার কী মানে? আমি তোমাকে মানা না করা বা সাপোর্ট করার কারণে আমি দাইউসের গুনাহয় গুনাহগার হবো। তাছাড়া হাদীসে আছে,
রাসুল (সা:) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রনেতা তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ লোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পরিচারক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এক কথায় তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে”। (বুখারী : ৭১৩৮; মুসলিম: ১৭০৫)
আর এইজন্য মা আমাদের সঠিকটা শিখানোর মানানোর চেষ্টা করেন। মা'ই হল আমাদের পরিবারের প্রধান।
---তাহলে আমি বোরকা, নিকাব ছাড়া পরীক্ষা দিতে গেলাম তখন মানা করনি কেন?
: কারণ ইসলাম এমন একটা ধর্ম যেটা কাউকে কোন বিধান চাপিয়ে দেয় না। ইসলামকে মন থেকেই, ভালোবেসে আদায় করতে হয়। ইসলামকে যদি তুমি অন্তর দিয়ে পালন না কর তাহলে তা আল্লাহর কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ বলেন,
"দ্বিনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।
[সূরা বাকারা ২:২৫৬]"
আর সবকিছু বলার বা বুঝানোর সময় এবং সুযোগ থাকে। সময়, সুযোগ মতো বললেই আল্লাহর ইচ্ছায় অপর পক্ষকে মানানো যায়।
-- তোমার মা যে চাপিয়ে দেয়, বলা যায় জবরদস্তি করে।
: মায়ের ব্যপারটা তুমি ধীরেধীরে বুঝতে পারবে। আপাতত মাকে নিয়ে আমরা আলোচনা না করি কেমন?
সে বাচ্চাদের মত করেই সবকিছু বুঝায় আমার এত ভাল লাগে। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে।
হ্যা, সেদিন ইয়াসিরের কথা রেখেছিলাম। তার বুঝানোর ভাষাটা এত মধুর ছিল না শুনে পারিনি। সে জবরদস্তি করেনি কিন্তু কথাগুলো এমনভাবে বললো মানতে বাধ্য হয়েছি। প্রপিকে আমার লাল শাড়ি, লাল লিপস্টিকের যে ছবি দিয়েছিলাম সেটাও ডিলিট দিয়েছি। ফেইসবুকের গুনাহের ভয়াবহতাও ছিলো আবার ইয়াসিরের প্রতি কিছুটা ভালোলাগাও ছিল। হুম, এতদিনে ওর প্রতি কিছুটা ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করেছে। কেন যেন সে বাসায় না থাকলে খালি খালি লাগে। বুকটা খা খা করে।
সেইবার পরীক্ষা শেষে শ্বশুর বাড়িতে আসার পর ইয়াসিরের এক ফুফুকে দেখতে পেলাম যার সাথে আগে কখনো পরিচয় হয়নি। উনি এসেছেন কয়েকদিন হয়েছে, আমাকে দেখেই কেমন একটা ভাব ধরে বলে উঠলেন, ওহ রোকেয়া(আমার শাশুড়ী) কি বেপর্দা মাইয়া ঘরে আনলি বোরখা না পইরা বাপের বাড়ি থেইকা শওর বাড়ি আইল। তুই কিছু কইতে পারস না। অন্য বউদের দেখলে পরান জুড়ায়া যায়।
আমি সেদিন বোরখা না পরেই চলে এসেছিলাম। ভাবলাম এইবার রক্ষা নেই। দুই শাশুড়ী মিলে আমাকে কি ধোলাই দেয় আল্লাহ জানেন। আমার বাঁচানোর কেউ নেই। ইয়াসির এমনিতেই মায়ের সামনে কিছু বলে না, সেখানে দ্বীনের ব্যপারে আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার প্রশ্নই আসে না । আমার অবাক করে দিয়ে আমার শাশুড়ী বললেন,
--বুবু, সুমাইয়া আজকালকার পড়ালেখা জানা শহুরে মাইয়া, আমার পরিবারের সাথে মিলতে কিছুটা সময় লাগবে তো। সুমু বাচ্চা মানুষ বাদ দেও তো।
: কী যে কস রুকাইয়া! এত বড় দেমড়ী মাইয়াকে তুই বাচ্চা কইলি? আর তাছাড়া বিয়ার পর কিয়ের পড়ালেহা কও তো? জা'দের সাথে কাজ করবো। এটাই তো দুনিয়ার নিয়ম।
-- আরে বুবু বুঝ না কেন, ও আমার ছোট ছেলের বউ; আমার সবচেয়ে ছোটটা। অন্যদের কাছে যত বড়ই হউক আমার কাছে তো ছোটই। জান বুবু, সুমাইয়া আমার নাতিদের পড়াই। কত আদর করে পড়াই তুমি না দেখলে বিশ্বাসই করবে না।
আমার ভাগ্য ভাল বলেই ওর মত বরং আমার সব বউদেরই আমি পেয়েছি।
-- বিয়ার পর মাইয়া মাইনসের এত পড়ালেখার কি দরকার বাপু বুঝি না। আইজকাল মাইয়াগো কত ঢং। সেই চুলাই টেলতে অইব।
: কি যে কও বুবু। চুলা তো টেলতে হবেই। নয়তো নিজের রান্নাটা কে করব। আর আইজকাল ছেলেরাও চুলা টেলে। আমার ইয়াসির বউদের চেয়ে ভাল রান্না পারে। মাঝেমাঝে বাড়িতে আসলে চুলা দখল করে। চুলা টেলার মধ্যে লজ্জার বা খারাপের কিছু নেই।
আর শুন বুবু, সুমাইয়া যদি পড়ালেখা না করতো আমার নাতিদের কে পড়াইতো কও তো? বাইরের মাষ্টার আসতো কিন্তু সেটা বাধ্য হয়ে। সুমাইয়া যত শিক্ষিত হবে ভবিষ্যতে আমার নাতিনদের জন্য মাষ্টার রাখতে হবে না। পুরুষ মানুষ ঘরে আসার সুযোগ থাকবে না।
মেয়েরা পড়ালেখা না করলে আমাদের মেয়েদের তো ছেলেদের কাছে গিয়ে পড়তে হবে! তাই না?
ফূফু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আবার বললেন,
: বুঝি না বাপু, আইজকাল তোমার কি অইল' স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেশত' অথচ আইজকাল মাইয়াগো সেইদিকে কোন পাত্তাই নেই। আমাগো সময়ে আমরা স্বামীর কথার বাইরে এক পাও দিতাম না। এই মাইয়া গুলারে কথা শুনানো যায়ই না।
-- বুবু, আমার ছোট বউ আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে, সে আমার কথা রাখেনি। হ্যা, হয়তো অন্য বউদের মত খুশি মনে হয়নি। সেটা অন্য ব্যপার। বুবু, আমাদের জমানায় আমরা ভুল জানতাম, স্বামীর পায়ের নিচে কখনো স্ত্রীর বেহেশত হতে পারে না। সঠিক হলো মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশত। স্ত্রী সেও কারো সন্তান, ওর মায়ের পায়ের নিচেই ওর বেহেশত। হ্যা, তবে এটা আছে স্বামী অসন্তুষ্ট রেখে স্ত্রী মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটাও আছে সর্বোত্তম পুরুষ সে যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। এক্ষেত্রে বুবু, আমাদের ধর্মটা খুবই ভারসাম্যযুক্ত ধর্ম। স্ত্রী বা স্বামী উভয়কেই উভয়ের উপর অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেখানে সবার উপর সবার হক আছে, সবার উপর সবাইকে মর্যদা দেওয়া হয়েছে।
হ্যা, ধর একজন স্ত্রীর স্বামী খুব খারাপ, বিয়ের পর থেকেই তাকে অত্যাচার করে, স্ত্রীর কোন দায়িত্বই পালন করে না। তার পায়ের নিচে কীভাবে স্ত্রীর বেহেশত হতে পারে?
অন্যদিকে মা, সে জন্মের পর যদি কোন দায়িত্বও পালন না করে, শুধু গর্ভাবস্থার কষ্টের জন্য সে সন্তানের সদাচারণের হকদার। হাদিসে বলা হয়েছে, মা যদি মুশরিকও হয় তবুও তার সাথে সদাচারন কর।
মুশরিক মানে শিরককারী, মানে শিরক করা হল ইসলামের কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যেও সবচেয়ে বড়। সুতরাং মায়ের নিচেই সন্তানের( পুত্র বা কন্যা) বেহেশত।
বুবু, বুঝতে পারছ? আমরা না হয় আগে জানতাম না, এখন জেনেও কেন ভুল বলে গুনাহগার হব?
ফুফু রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
: হয় হয়, জানি তোর কাছে তোর বউরা ছাড়া দুনিয়ার কেউই ভালা না। আমরা তো মানুষই না।
তোর বউগুলার কোন দোষই নেই। এগো পড়ালেহাই করাইস, ঘরের কাজ সব তুই করিস, এদের বাইন্ধা কাওয়াইস।
--বুবু তুমি ভুল বুঝছ, আমার কেন রান্না করে খাওয়াতে হবে? এইটা এদের সংসার, এদের জামাইদেরই টাকা। এরা এদের নিজেদের জন্য, সন্তানদের জন্য রান্না করে, সেখানের উপর আমি একা খাইতে তো কোন সমস্যা নেই।
: বুঝেছি বুঝেছি, এবার তোর তীল তীল করে ঘড়া সংসারটাও এদের দিয়া দে।
বলে আমার শাশুড়ীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
এইসব কথাই আমার সামনে হচ্ছিল। স্পষ্ট বুঝেছি, আমার শাশুড়ীর মুখ কিছুটা মলিন হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে যাই হউক আমার ভালই লেগেছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে পায়ের নিচে বেহেশত নিয়ে বলা কথাগুলো। আমিও এইটা মানতাম না, কিন্তু এইভাবে কখনো ভাবিনি। আমি যতগুলো শাশুড়ী সম্পর্কে শুনেছি
তার মধ্যেও কোন শাশুড়ীই বউকে এভাবে সাপোর্ট করে না। বউয়ের ত্রুটি গুলোকে এভাবে লুকাই না। আমি আমার বান্ধবীদের কাছে শুনেছি তাদের অনেকের শাশুড়ি নামাজ কালাম পড়ে ইসলামের অনেক হুকুম আহকামই মেনে চলে কিন্তু আবার বাইরের মানুষকে বউয়ের ত্রুটিগুলো বরং আরো অনেককিছু বানিয়ে বানিয়েও বল। যদিও আমার জানামতে গীবত করা অনেক বড় গুনাহ। মিথ্যা অপবাদ দেওয়া তার চেয়েও বড় গুনাহ৷
সেক্ষেত্রে আমার শাশুড়ীর এই বিষয়টা অনেক ভাল লেগেছে। উনার অতিরিক্ত শাসন গুলো বাদ দিলে উনার মধ্যে একজন বুদ্ধিমতি, স্বশিক্ষিত মহিলা লুকায়িত।
যাক, বিকেলে ফুফু চলে যাওয়ার পর শাশুড়ী মা আমাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে গেলেন।
আমাকে কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে দিয়ে বললেন, জানিস বউ তোর শ্বশুর যখন মারা যাচ্ছে আমার শুধু ঘরের তলাটাই ছিল। পাশের জায়গাগুলো আমার ছেলেরা দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনেছে। এই ভিটা ভরাট করার জন্য রাতের আঁধারে মাঠি কেটেছি, যাতে আমার ছেলেদের কিছু টাকা বাঁচে। টাকা আমার কাছে তেমন মূল্যবান ছিল, এখনো। তারচেয়েও বেশি মূল্যবান তীল তীল করে গড়ে তুলা আমার স্বপ্ন, ইসলামী পরিবার। আল্লাহর ইচ্ছায় হয়তো আমি কিছুটা সফল। মা'রে তুই আমার সবচেয়ে আদরের এবং আমার অন্য বউরাও। তোদের আমি শাসন করব, ভালোবাসব। আমার শাসনে ভুল হতে পারে, তোদের ভাল নাও লাগতে পারে। কিন্তু অন্য কেউ তোদের দিকে আঙুল তোললেও আমার ভেতরটা জ্বলে উঠে। আমি সহ্য করতে পারি না কেউ আমার বউদের কিছু বললে। আবার তোদের কারো কষ্ট হলে একটা শরীরে কষ্ট হওয়ার মতো আমারও ভীষণ কষ্ট হয়। জাহান্নাম সত্য, জাহান্নামের আগুন সত্য, মা'রে আমি ভাবতে পারি না আমি বা আমার কলিজার টুকরো বউ, বাচ্চারা আগুণে জলবে। আমি জানি তুই আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে যাবি, যদি একটু চেষ্টা কর তবে সেটা খুব শীগ্রই সম্ভব। ইন শা আল্লাহ।
সেদিন অনেকগুলো পেয়েরা নিয়ে বাড়িতে আসি বউ,শাশুড়ী মিলে। বাড়িতে এসে বললেন,
বড় বউ দেখ সুমু পেয়েরা নিয়ে এসেছে, লবন, মরিচ দিয়ে মাখাও সবাই মিলে খাই।
বুঝেছিলাম, উনি খুব বিচক্ষণ মহিলা। এমনি এমনি বাড়ির সবাই উনাকে এত মানে না। এত বড় সংসারটা এমনি এমনি এত সুন্দর ঠিকে নেই। উনার বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতাই এই সংসারের মানুষ গুলোকে এত ভালোবাসায় বেধে রেখেছে। আরো বুঝতে পারলাম উনি উনার বউদের শাসন করতে পারবেন, কথা শুনাতে পারবে অন্য কেউ খবরদারি করতে পারবে না। অবশ্য পুরো ব্যপারটা আমার এত চমৎকার লেগেছে, অনেক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
মাঝেমাঝে বেশ অবাক লাগে উনি পুরনো আমলের মহিলা, শিক্ষিত নয়। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে এত কিছু সঠিকভাবে কীভাবে জানে।
শিক্ষাকে এত ভালোভাবে মূল্যায়ন শিক্ষিতরাও করতে পারেন না।
উনার প্রতি একটু একটু ভালোলাগা কাজ করলেও উনার নিষ্ঠুর শাসন উনাকে আপন করে নিতে বাধা দিচ্ছে। বেলকনিতে বউরা যেতে পারবে না, উঠানের বাইরে যেতে পারবে না। নীচতলার লিভিং রুমে গল্প করা যাবে না। গল্প করতে চাও তো উপরের বসার ঘরে কর। নির্দিষ্ট টাইমে খেতে হবে। কি অদ্ভুত! বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স, তিন নাম্বার জায়ের মেয়ে, একেও বলে স্লিভলেস কাপড় পড়ানো যাবে না। কেন এত কঠোরতা। সেইবার বাবার বাড়ি থেকে আসার সময় খুব সুন্দর স্লিভলেস জামা আনি আমাদের আইশা মা মনির জন্য, অবশ্য জামাটা আমি খানিকটা জেদ করেই এনেছি। এত আদর লাগে ওকে! মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ওকে বুকের সাথে আটকিয়ে রাখি।
শাশুড়ী দেখে খুশি হয়েছেন কিন্তু মানাও করেছেন এইটা পরিয়ে বাড়ির বাইরে যেন নিয়ে না যাওয়া হয়। খুব রাগ লেগেছিল, আমি শান্ত স্বভাবের মেয়ে হলেও সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম,
-- কেন মা এই বাচ্চা মেয়েটিকেও আপনি পর্দা করাবেন? নাকি ওর জন্যও পর্দা ফরজ। পারলে ওকেও জোব্বা পড়ান। এই বাচ্চা মেয়েটিকে যে কাপড়গুলা পড়ান সে তো গরমে অস্থির হয়ে উঠবে।
: না রে মা, তোর প্রশ্নের কোনটিই ওর জন্য নয়। প্রথম কথা, গরমটা ওকে সহ্য করার অভ্যাস করাতে হবে। আর দেখনা মা, হাতা ছাড়া কাপড়ে আমার নাতিনটার হাতগুলো কত সুন্দর লাগে, যদি মা কোন দুষ্ট লোকের নজরে পড়ে? ও মেয়ে, মেয়েকে আল্লাহ আকর্ষণীয় করেই সৃষ্টি করেছেন ওর উপর তো একসময় পর্দা ফরজ হবেই।
--তাই এখন থেকেই ওকে পর্দার পাঠ পড়ান। যেটার আগামাথা সে বুঝে কি না সন্দেহ।
: হ্যা বুঝে না কিন্তু আইশার মাথায় এই কথা গুলো জায়গা করে নিবে।
আমার আর এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হল না। অনেকটা রাগই হচ্ছিল। হয়তো শাশুড়ী বুঝতে পেরেছেন। শুন মা, আজ রান্না নেই উঠানে আয়, সবাই মিলে খুব মজা হবে।
_আমার_শাশুড়ী
পর্ব--০৩ এবং শেষ পর্ব
Nilofa Nilo(উম্মে জাবির)
রাগে গজগজ করতে করতে উঠানে গিয়ে দেখিত বাচ্চারা সবাই খেলতেছে আর ভাবিরা কেউ সাইকেল চালাচ্ছে কেউ দোলনায় দোলছে।
শাশুড়ী জানেন আমি রেগে আছি, আমার দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বললেন,
: যা মা তুই ওদের সাথে মজা কর। তোর ইচ্ছে তেমন কর। দেখিস ভাল লাগবে।
-- এই সাইকেল ভাবিরা চালায়?
: হুম, মেজ বউ সাইকেল চালাতে জানতো। সে খুব দুরন্ত ছিল, সহজেই অভিমান করতো। বাড়ির ছোট মেয়ে ছিল হয়তো তাই এমন ছিল।
ওর খুশির জন্য সাইকেল নিয়েছিলাম। পরে দেখি মেজ বউ সবাইকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছে।
মেজ বউ বলে সাইকেল চালালে শরীর মজবুদ থাকে। বাবার বাড়িতে খুব আহ্লাদে বড় হয়েছে আমি শাশুড়ী বলে তো ওর আবদার, আহ্লাদ কেড়ে নিতে পারি না? ইয়াসির বাড়িতে না থাকলে ওরা যা ইচ্ছা তাই করে। শুধু পর্দার মধ্যে থাকতে হয় এই আর কি।
ছোট বউ?
আমি এসব শুনছিলাম আর আনমনা হয়ে ভাবছিলাম যে মহিলা দ্বীনের ব্যপারে এত কঠোর সে কীভাবে বউদের সাইকেল চালাতে দিতে পারে?
কীভাবে বউদের ছোট ছোট চাহিদারও খেয়াল রাখে। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। উনার ডাকে চমকে উঠে উনার দিকে ফিরতেই আবার বললেন,
: তুইও বাবার বাড়িতে যেমন ছিলি তেমনভাবে থাকতে পারবি।
মনে মনে বলছিলাম এত বাধা নিষেধের মধ্যে বাবার বাড়ির ফিলিং কখনো আসবে না।
তিনি হয়তো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে আবার বললেন,
: আমি তোদের খুব শাসন করি তাই না? জানিস তো মা, নিচের বসার ঘরে যে কোন সময় যে কেউ আসতে পারে। তোরা গল্প করার সময় তোদের কাপড় -চোপড় ঠিক থাকে না।
তোরা অপ্রস্তুত অবস্থায় যদি এমন কেউ আসে যার সামনে যেতে তোর ভাল লাগবে না। এইজন্যই তোদের জন্য উপরে আলাদা বসার ঘর বানিয়েছি।
আমি অনেকটা আগ্রহী হয়ে বললাম তবে বারান্দায় কেন যেতে দেন না।
: মা'রে আমাদের বাড়িটা ঠিক মেইন রাস্তার পাশেই, আর বারান্দা গুলো সব বলা যায় রাস্তার উপরই। তোরা ওইখানে দাড়িয়ে থাকলে রাস্তার ,`2 w£যাত্রীদের সহজেই চোখ পড়ে যাবে। মা'রে আমি তোদের উপর জুলুম করি না, শরিয়তের বাইরে তোদের উপর কিছু চাপিয়ে দিইনি, দিবও না।
আমারও মেয়ে আছে, আমি তোদের প্রতি মানে পরের মেয়ের প্রতি যাই করবো আমার মেয়েদের উপরেও সেগুলো ই হবে। আমি তোদের কষ্ট দিলে আমার মেয়েরাও শ্বশুর বাড়িতে শান্তিতে থাকতে পারবে না। তাই আমার ছেলেদেরকেও বলে দিয়েছি ওরা যেন কখনো বউদের প্রতি অন্যায় না করে।
আর বিয়ের পরে মেয়েদের আসল বাড়ি স্বামীর বাড়ি। বাবার বাড়িতে ওরা মেহমান হয়েই যায়। মেয়েদেরও বলেছি, ওরাও যেন এইখানে আসলে কখনো ভাবিদের ত্রুটি না খোঁজে। আমার বউদের ত্রুটি দেখার জন্য আমি আছি। আলহামদুলিল্লাহ আমার মেয়ে দুটোই খুব ভাল আছে, যেমন তোরা ভাল আছিস। আর আমার মেয়েরা বাবার বাড়িতে আসলে ঠিক আমার কাছে যেমন আমার বউরাও তাদের সাথে তেমন আচরণ করে। তাদের মিল দেখলে আমার মন ভরে উঠে।
থাক এসব কথা আরেকদিন বলবো। এখন ওদের সাথে যা!
আমি ওইখানে গিয়ে দোলনায় বসে ছিলাম, কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছিল ইনি কত সুন্দর করে এই সংসারটাকে নিজের মতো আগলে রেখেছেন। সবাইকে প্রচণ্ড আন্তরিকতায় বেধে রেখেছেন।
বউগুলাকে দেখলে মনেই হয় না এরা এই বাড়ির বউ, মনে হয় এইটা তাদের বাবার বাড়ি। এত স্বাধীন!
ইয়াসির বৃহস্পতিবার বাড়িতে আসলে, শাশুড়ী ইয়াসিরকে রুমে পাঠিয়ে দেন, সরাসরি বলেই দেন, রুমে যা, সুমাইয়া একা!
ইয়াসির যতদিন বাড়িতে থাকে উনি প্রায়ই আমাকে বলেন, বউ রুমের দিকে যাও। দেখ ইয়াসিরের কিছু লাগবে কি না। আমি বুড়ো হয়ে গেছি আর কত ছেলেদের পিছনে সময় দিব, এইবার ইয়াসিরের সবকিছু দেখার দায়িত্ব তোর।
প্রথম প্রথম শুক্রুবারে ফজরের নামাজের পর ঘুমালে ঘুম ভাঙতে দেরী হতো, অনেকসময় ইয়াসির আগে উঠে গেলে বা আমার উঠতে দেরি হলে দেখতাম ইয়াসির নাস্তা করে বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। আমি উঠে ভয় পেতাম। যদি ইয়াসিরকে কেউ খাবার না দেয় বা উঠতে দেরি হয়েছে বলে বকা শুনি? কিন্তু না, ইয়াসিরের বউকে উঠে যে খাবার দিতে হবে এমন নয়। আমার শাশুড়ী দিয়ে দেন। উনার কথা হলো, ছেলেটা আগে আমার, বউ আসছে সেদিন, এতদিন দিতে পারলে আজ কেন আমি বউয়ের জন্য বসে থাকব? অনেকসময় দেখা যায় ভাবীরাও ঘুম থেকে উঠেনি কিন্তু উনি কাজের মেয়েকে নিয়ে নিজেই নাস্তা রেডি করে দিয়ে দিয়েছেন।
এই জিনিসটা আমার খুব বেশি ভাল লেগেছিল কারণ আমার একটা পরিচিত পরিবার আছে, যেখানে দুইটা কাজের মেয়ে থাকার পরও বাড়ির ছেলেকে সকালে না খেয়ে যেতে হয় এমনকি একটি অবিবাহিত বোনও আছে তাও বউয়ে দেওয়ার জন্য সকালে নাস্তা দেয় না। এই কথাটি অই শাশুড়ীটি বউয়ের বদনাম করতে গিয়ে আমার মা'কে বলেছিল। আমি মাকে এমনটা বলেছিলাম, ছেলের প্রতি এত দরদ থাকলে মা'ও নাস্তা দিতে পারে। বোনও দিতে পারে, বউকেই কেন দিতে হবে?
আজ ঠিক এমনটা আমার শ্বশুর বাড়িতে দেখে বেশ ভাল লেগেছিল।
ভাবীরা সবাই মুচকি হাসে, একদিন মুচকি হাসার কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললেন,
: আমাদের উনারা দেশে আসলে, যারটা এসেছে তার জন্য কাজ করা নিষেধ উনি যতদিব বাড়িতে থাকেন। মায়ের কথা হলো,
: পুরুষের জন্য সবচেয়ে শান্তির স্থান হল স্ত্রীর। আমার ছেলে এত কষ্ট করে দেশের বাইরে থাকে সবাইকে ছেড়ে, আমরা ভাল থাকার জন্য। ওরা কিছুদিনের জন্য বাড়িতে আসলে ওদেরকে ভাল রাখার দায়িত্ব আমাদের।
তোরা যদি বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকিস তবে আমার ছেলেদের শান্তি কোথায়।
তোমাদের বিয়ে হওয়ার পর থেকেই মা'কে দেখি ইয়াসিরের সাথে তেমন গল্প করে না। বাড়িতে আসলেই রুমে পাঠিয়ে দেয়। আমরা খেয়ে চলে যাওয়ার পর তোমাদের একসাথে খেতে দিই। এইটাই আমার শাশুড়ীর নিয়ম।
আমাদের জন আসলেও আমরা দুইজন একসাথে খাবার খাই যখনই সম্ভব হয়। অনেক সময় তো বাচ্চাদের জন্য একসাথে খাওয়া হয় না।
উনি বলেন, যে ঘরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা বিদ্যমান সে সংসারে শয়তান সহজে সুযোগ পায় না।
শাশুড়ীর ব্যপারে এসব কথা শুনে আমি একেবারে থ হয়ে গেছি! এমনভাবে আমার ভাইয়ের বউকে নিয়ে আমার মা'ও হয়তো ভাবতে পারবেন না। একজন সেই আমলের মহিলা কীভাবে এত গভীরভাবে ভাবতে পারে! তাও ছেলের বউদের নিয়ে!
শাশুড়ীর মমতাময়ী আরেকরুপ জেনে অবাক না হয়ে পারিনি।
তিন নাম্বার বউটার প্রথম বাচ্চার পরে আবার প্রেগন্যান্ট। ভাবীর যদি কিছু খেতে ইচ্ছে করে উনি যেভাবেই হউক সেটার ব্যবস্থা করবেনই।
ভাবিকে নিয়মকরে ডাক্তারের কথামতো খাবার খেতে বলা, ঠিকমতো ওষুধের কথা মনে করিয়ে দেওয়া। ঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, টাইমের আগে বাপের বাড়িতে পাঠানো।
আমার বিয়ের পর আমি উনাকে শাশুড়ীর মেয়ে ভেবেছিলাম, যেভাবে উনার যত্ন নিচ্ছিলেন। পরে জানতে পারি উনি মাত্রই কনসিভ করেছেন।
পরে উনার কাছে শুনলাম, এই টাইমে বউরা যখন ইচ্ছা বাবার যেতে পারে। কোন বাধা নেই!
বাহ, উনি শাশুড়ী কিন্তু শাশুড়ীর চেয়ে মা'ই বেশি।
ধীরেধীরে উনার প্রতি কখন ভাললাগা, ভালবাসা শুরু হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। উনার সমস্ত বাধা নিষেধকেও ভালো লাগতে শুরু করেছিল।
অন্য বউদের মত আমারও মাথাই ঢুকতে শুরু করেছে উনি যা কিছু করছেন আমাদের আখিরাতের ভালর জন্যই করছেন। কিন্তু উনি এখনো হয়তো বুঝতে পারেনি উনার প্রতি আমার মনে সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে।
সেদিন যখন উনি দূর্বলতার কারণে হঠাৎ বেহুশ হয়ে যান, সেদিন আমি বুঝেছিলাম ঠিক কতটুকু উনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। হুম আমার শাশুড়ীকে? নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। শুধু মনে হচ্ছিল আমি উনাকে হারিয়ে ফেলবো। উনার জায়গায় আমার মা হলে হয়তো আমার এমন লাগার কথা। সেদিন সারারাত উনার রুমে কাঠিয়ে দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি নিজের রুমে গেলেই ফিরে এসে উনাকে পাব না। অথচ উনার সাথে ইয়াসিরও ছিল তাও উনাকে একা ছাড়তে পারছিলাম না।
উনি চোখ খুলতেই শুধু বলেছিলাম, মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। এই সংসারের, আমার, আপনার ছেলের আপনাকে খুব প্রয়োজন বলে কেঁদে দিয়েছিলাম। উনি শুধু মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন,
"এটাইতো আমার সংসার, আজ আমার সংসারটা পরিপূর্ণ৷ এভাবেই থাকিস মা, আমার মা হয়ে, আমার মেয়ে হয়ে"
এই হল আমার শাশুড়ী।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
সমাপ্ত