মেয়েদের সংসার জীবন | স্বামীর সংসার | সংসার জীবনের কষ্ট

 সংসার জীবন কি

সংসার জীবন কি

শেষপর্যন্ত তুই একটা মাছওয়ালার ছেলেকে বিয়ে করবি ইশা? আমি এটা মানতেই পারছিনা! ছেলের কি অভাব ছিলো তোর জন্য? কম প্রস্তাব আসতো তোর জন্য? ''


আমি বিস্ফোরিত চোখে, আমার সবচে কাছের বন্ধু  রিয়ার দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম, "আমার বিয়ে একজন জেলের ছেলের সাথে হচ্ছে, এবং এজন্য তোর যদি ভীষণ আপত্তি থাকে, তবে তুই বরং বিয়েতে আসিস না।"  


আমার বিয়ে নিয়ে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবার ঘোর আপত্তি!  আর থাকবেই না কেনো? আমার বাবা শাখাওয়াত হোসেন একজন প্রথম সারির শিল্পপতি!  তার একমাত্র মেয়ে ইশার বিয়ে যদি একজন অজপাড়াগাঁয়ের দরিদ্র জেলের ছেলের সাথে হয় তবে তা আসলেই দৃষ্টিকটু! অনেক বিশাল বিশাল পরিবার থেকে আসা সব সম্বন্ধ উপেক্ষা করে আমার বাবা যখন দরিদ্র জেলে জামিল মিয়ার ছেলে  সাকিব এর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন, তখন কারো কাছে তিনি হাসির পাত্র, আবার কারো কাছে তিনি একজন ভীষণ বুদ্ধিহীন লোক বলে গন্য হয়ে যান। 


বাবার অফিসে সাকিব তখন সবে সবে জয়েন করেছে, তুখোর মেধাবী আর কি দারুণ আত্নবিশ্বাসী ছেলে সে। কাজে, কথায় প্রতিটি জায়গায় তার দারুণ প্রতিভা। তখনও সাকিব আমার বাবার নজরে সেভাবে আসেনি। একদিন এক কনফারেন্সে সাকিব এর আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স দেখে বাবা তাকে রুমে ডেকে পাঠান বাহবা দেয়ার জন্য। কথাপ্রসঙ্গে সাকিব বাবা কে বললো,

"ধন্যবাদ স্যার, আপনার প্রসংশার প্রতিটি শব্দ আমার বাবাকে আমি বলবো। উনার জন্য আমি আজ এখানে।" 

বাবা যখন জানতে চাইলেন সাকিবের বাবা কি করেন? 

কোন ধরনের কোন ভনিতা ছাড়াই সে বলেছিলো, "আমার বাবা একজন জেলে, মাছ বিক্রি করতেন। এখন করেন না। আমি মাস শেষে হাতখরচ দিই, বাবাকে এখন বিশ্রাম দিয়েছি"।


তার সততা, নিজের শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে সেদিন ই বাবা আমাকে তার কথা বলেন। বাবার প্রতি আমার আজীবন ভীষণ ভরসা, তাই এই প্রস্তাবে আমার কোন অমত ছিলোনা। 


 কিন্তু বিপত্তি ঘটায় সাকিব, সে সরাসরি বাবাকে না করে দেয়,এই বিয়ে করবেনা। কারন সে চায় না, তার শ্বশুরের দয়ায় বেঁচে থাকতে! সে তার আত্মসম্মান নিয়ে থাকতে চায়। এতো টাকা পয়সা, এত কিছু যার আছে সেরকম পরিবার তার বাবাকে সম্মান দিবেনা, তাই এই বিয়ে সে করবেনা। 

 

বাবা তাকে আস্বস্ত করে শুধু বললেন, "সাকিব আমি তোমার সাথে শুধু নয়, তোমার পরিবার এর সাথে আত্মীয়তা করতে চেয়েছি। তুমি শুধু আমার মেয়ে টাকে বিয়ে করো, তোমার বাবার কোনও অসম্মান হবেনা। উনি আমার বেয়াই হবেন। "


যেদিন সাকিবের বাড়িতে আমার হবু শ্বশুরের সাথে বাবা দেখা করতে যান, খুব আড়ষ্ট ছিলেন ভদ্রলোক।  ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু বলেছিলেন,


 " পোলাটা আমার একমাত্র সম্বল,  বউ মরণের পর ছোড থেইকা হেরে আঁকড়াইয়া ধইরা আমি মানুষ করছি, এখনও বাইচা আছি, তার থেকে আমারে আলাদা কইরেন না। "

 

বাবা উনাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলেছিলেন,


 "বেয়াইসাহেব আপনার ওমন রত্নের মতো ছেলের সাথে মেয়ের  বিয়ে দিতে পারছি এতো আমার সৌভাগ্য। "


তারপরো উনার চোখেমুখে ছিলো ভীতসন্ত্রস্ত ছাপ। 


সাকিবের সাথে আমার খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে হয়ে গেলো, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির যতো অনুষ্ঠান, সব হলো তাদের সেই অঁজোপাড়া গায়ে। 


জেলের ঘরে ওমন বড়লোক বাড়ির বউ দেখতে সবাই সে কি ভীড়! 

দারুণ ব্যাস্ততায় খুশি মনে নিজের সবটুকু দিয়ে করলেন আমার শ্বশুর। 

যেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসবো, সেদিন জোড় করে আব্বাকে ঢাকায় নিয়ে আসলাম।


ছিমছাম ছোট বাসা আমাদের,  ইতিমধ্যে সাকিব তার চাকরি টাও পাল্টে নিলো। আমাদের তিনজনের বেশ হয়ে যায়। 


এখনো আমার শ্বশুর আমায় কিছু বলতে ভীষণ ইতস্তত বোধ করেন, আমিই উনার সাথে গল্প করি, সকাল সন্ধ্যা চা করে খাওয়াই।  যখনই বাবার বাসায় দাওয়াত থাকে তিনি যেতে চান না, ভীষণ লজ্জা পান। জোড় করে নিয়ে যাই। আমার বাবা তাকে সর্বোচ্চ আতিথেয়তা নিয়ে আপ্যায়ন করেন। আজকাল বাবা আর আব্বা একসাথে হাঁটতে বের হোন বিকেল বেলা। সাকিব বা বাবার অফিসের কোনও পার্টি বা দাওয়াত থাকলে আব্বাকেও সাথে নিয়ে যাই আমি। সেসব জায়গায় আমি সারাক্ষণ তার সাথে সাথে থাকি।  তার আঞ্চলিক কথার টান কিংবা সাহেবী ভাবের অভাব কোনকিছুই আমায় লজ্জায় ফেলে না। বরং ভীষণ গর্ববোধ হয় আমার এতো ভালো মানুষ আমার শ্বশুর।  


একদিন আব্বার ভীষণ জ্বর আসে, আমি আর সাকিব সারারাত আব্বার পাশে বসে ছিলাম, জলপট্টি দিলাম। সকালের দিকে যখন আব্বার জ্বর ছেড়ে যায়, আব্বা একটু ঘুমিয়ে ছিলেন। 


সেদিন বিকেলে আমাকে আব্বা ডাকলেন, তিনি আমাকে সবসময় আম্মা বলে ডাকতেন। 

-আম্মা কই গো, একটু আইবা আম্মা? 

-জ্বি আব্বা, আপনি ঠিক আছেন? কিছু লাগবে? 


-আম্মা একটু বও, একটু কতা কমু। অনেক কাল আগে আমার জ্বর আইসিলো, তোমার শাশুড়ী তখন বাইচা আছিলো, হেয় সারারাইত আমার মাতায় ফানি ডালছে আর কাইন্দা আমার লাইগা দোয়া করছিলো।  হেইদিন ও সকালে আমার জ্বর ছাইড়া যায়। আমি গরীব মানুষ, গরীব মাইনসের অসুখ অয়না আম্মা।  আমারো হয়নাই। কাইল রাইতে যখন আমার জ্বর দেইখ তুমি উচাটন করতে ছিলা, আমারে যত্ন করলা! মারে আমার খালি মনে অইচে, আমি অনেক ভাইগ্য কইরা তোমার মতো পোলার বউ পাইছি। 

বলেই আমার হাত ধরে অঝোরে কান্না করে দিলেন আমার শ্বশুর! আমার শ্বশুর জামিল মিয়া! আমার আব্বা। 


একোনও দূঃখের কান্না নয়, সুখের কান্না।


-ছোটগল্প 

আমার শ্বশুর জামিল মিয়া।


বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post