ভাই বোনের ভালোবাসা | ভাই বোনের কষ্টের স্ট্যাটাস

 ভাই বোনের মধুর সম্পর্ক

ভাই বোনের মধুর সম্পর্ক

কাল কলেজের অনুষ্ঠানে নাচানাচি করে সকালে বাসায় এসে কোন রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছি জানি না। নিশ্চয় আপুর রুম এইটা। কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধ এই রুমে। ও মনে হয় বাসায় নেই। ভার্সিটি গিয়েছে। আমার রুমে তো নিজের মোজা আর শার্টের গন্ধে নিজেরেই বমি আসে। 


হঠাৎ আপুর চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে।  

-এই ছাগলটা আমার রুমে কেন? পুরো ঘরে পাঠা পাঠা গন্ধ বেড়োবে এখন। এই উঠ, যা বের হয় রুম থেকে। 


গায়ে কয়েকটা কিল ঘুসি দিতেই ঘুম আর একটু ভাঙ্গল। কোন মতে উঠে ঢুলতে ঢুলতে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এতক্ষন নাকে সুবাস ছিলো। নিজের রুমে আসতেই আর নেই।  

বাসায় মেহমান এলে সব গাদাগাদি করে আমার রুমে। আপুর রুম টা কত বড়। সব কেমন যেন গুছানো। একটা জানলা আছে। এইটার জন্য রুমটা প্রতি আমার লোভ। আমার রুম টা সামনের দিকে জানলা খুললে রাস্তা। রাতের ১ টা অবধি মানুষ হাটে। সিগারেট খাওয়া যায় না। আপুর রুম টা পিছনের দিকে। ওদিকে সব গাছ। ওর রুমে শুধু কাজিনরা আসলে শুতে পারে। কাজিন-


ও শিট। মিতুকে ফোন করতে ভুলেই গেছি। আবার বাসায় না বিচার নিয়ে আসে। মামাতো বোনের সাথে প্রেম করলেও জ্বালা আছে। মায়ের বোনের কাছে বিচার পাঠিয়ে দেয়। উঠে ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলাম। 


আপু তখনো নাকি রুম পরিস্কার করছে। আমি নাকি গন্ধ করে ফেলেছি সারা রুম। দেখলাম আমার ফেলে আসা শার্ট গেঞ্জি সব ধুয়ে দিয়েছে। খেতে বসলাম। সবাই আসল। 

আজ মাছ রান্না হয়েছে। 

- মা মাছের মাথাটা কিন্তু আজ আমি খাবো, 


-আহা, কত শখ! আমি খাবো মাছের মাথা। তুই আবার মাথা খেতে জানিস? 

এই বলে মাথা টা নিয়ে নিলো আপু। 


-মা, তুমি কিছু বলো না আপুকে। 


মা বলল-

- ও খেতে চায়। খেতে দেয় না। 

-মায়েরা নাকি ছেলের পক্ষ নেয়৷ আর তুমি? 


- মেয়েকে তো বিয়ে দিয়ে দিলে চলে যাবে। যত ভালো ঘরে দিই না কেন আমি দেখব কি খাচ্ছে না খাচ্ছে? খাওয়াতে পারব? তোকে তো সারাজীবন খাওয়াতে পারব। 


-কখন দিচ্ছো বিয়ে? তারাতারি দিয়ে দাও। তারপর ওর রুমটা আমি নিয়ে নিবো। 


- কত শখ! মাথা ফাটিয়ে দিবো আর আমার রুমে গেলে। 


বিকেলে আপুর রুমে গেলাম। আপুর রুমে ডুকলেই মনে হয় ভিন্ন এক রুম। চারিদিকে কেমন টানাটানা গুছানো সব। বিছানার চাদর, পড়ার টেবিল, ওর জিনিসপত্র। জানলা দিয়ে বাগানবিলাস দেখা যায়। আর কোথায় থেকে যেন কাঠালচাঁপা ফুলের সুভাস। ওর সাথে অনেকক্ষন গল্প করে আসার সময় পারফিউমের বোতলটা নিয়ে এলাম। 


কিছুদিন পর বাসায় বেশ নাস্তা রেডি হচ্ছে। জানলাম আপুকে দেখতে আসছে। বিয়ের পাকা কথা ওরা আপুকে আগেই দেখেছে। 


বেশ খুশী সবাই। আপুকে বেশি খুশি লাগছে।আমারো বেশ খুশি লাগছে। সব হয়ে যাওয়ার পর মিতুকে ফোন দিলাম,

-জানো আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের মাসে বিয়ে। 

- বাহ, বেশ ভালো তো। এখন তাইলে তিশা আপুর রুমটা তোমার হবে। 

-মানে? আপু কোথায় থাকবে তো? 

-ওমা, আপু শুশুড় বাড়ি চলে যাবে না? তখন তো রুমটা খালিই পড়ে থাকবে। 


আমার মনটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে এরপর থেকে। আপু থাকবে না?  

একটা মাস কোনদিকে চোখের পলকে চলে গেল। আপুর বিয়ে হয়ে গেলো। আপুকে বিদায় দিতে আমার মনে হচ্ছিল কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। 

আপুর বিয়ের পর থেকেই বুঝা যায় কি হারিয়ে গেছে ঘর থেকে। সব যেন নিশ্চুপ। ঘরে টানাটানা গুছানো ভাবটা নেই। ঘরে সে হাসি খুশি ভাবটা নেই। খেতে বসলে আমি মা বাবা কেমন যেন চুপচাপ খেয়ে উঠি। আপু থাকতে এমন খাবার টেবিল চিন্তায় করা যেত না। 

আমি আপুর রুমে যাই এখন। কেমন যেন ঢিলেঢালা এখন রুম। সব আছে তারপর ও কেমন যেন। ফুল গাছ ও আছে তবে এখন আর কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধটা নেই।


আমি প্রায় আপুর রুমে গিয়ে বসে থাকি। ওর অনুভব পাই। ওর বিছানায় ঘুমাই না এখন। ঘুমালে মনে হয় এই বুঝি এসে মারবে।

-এই ছাগল, এই সৌরভ, উঠ। 

আপু আসে না। এই ভাবে ডেকে তুলে দেয় না। এইভাবে ঘুম ভাঙার আশায় আমার ঘুমেই আসে না।


আপু এখন বাসায় আসে দুই দিনের জন্য। আসলে এই রুম নিয়ে ওর কোন বাড়াবাড়ি নেই। মায়ের সাথেই থাকে। নানান কথা সংসারের। যে আপু গল্প আর কবিতা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প কর‍ত। এখন নুন পেয়াজ আর শাশুড়ীর গল্পে তার ঘন্টা চলে যায়। দুলাভাই সহ ঘুমাই সে রুমে। তারপর চলে যায়। সে রুমে তার কিছু ফেলে যায় না। শুধু ফেলে যায় আমার জন্য ওর গায়ের গন্ধ এই রুমে। 


আমি ওকে জিজ্ঞেস করি -

-তোর এই রুমের জন্য মন কেমন করে না? 


ও বলে-

-খুব করে রে। এই রুমটাই আমার বলতে শুধু আমার ছিলো। খাট, টেবিল, আয়নাটাও শুধু আমার ছিলো। এখন যতই আমি সব গুছিয়ে রাখি না কেন যেন ঠিক তা আমার নয়। 


দুপুরে খেতে বসলে মা আমায় মাছের মাথা তুলে দিলে। আমি বলি-

-আমাকে দিচ্ছো কেন? 

-তো কাকে দিবো? 

-আপুকে - 

বলতে গিয়ে থেমে যাই আমি। মাকে বলি, 

-তুমি মাছের মাথাটা হটবক্সে দাও আমি আপুকে দিয়ে আসি। 

-যা, একটা মাছের মাথা নিয়ে বোনের বাড়ি যায় নাকি? 

-আরে তুমি দাও না। কিছু হবে না। 


মায়ের কথা না শুনে আমি আপুর শশুড় বাড়ি গিয়ে ভুলেই করে ফেলি। বাসা ভর্তি মেহমান। কোরমা, পোলাও, খাসির রেজালা রান্না হয়েছে। আমি গিয়ে হাজির একটা মাছের মাথা নিয়ে। আপুরও সবার সামনে বক্স খুলে লজ্জায় পড়ে গেল। 


সবার খাওয়ার পর আমাকে খেতে বলে। আমি আপুকে ডাকতে গিয়ে দেখি আপু আবার ভাত রান্না করছে। 

-কিরে আবার ভাত রাধছিস? আমি খেয়ে এসেছি। 

-আরে না। পোলাও অনেক আছে। তুই খেয়ে ফেল। আমি মাছের মাথাটা খাওয়ার জন্য সাদা ভাত রাধছি। আসলে এইখানে মাথা খাওয়া হয় না। ছেলেরা খায় তো। 

আপু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে ভাত নাড়তে থাকে। 


খেয়ে আপুর রুমে গেলাম। এই রুমটা আমাদের বাড়ির রুম থেকে বিশাল। এইখানে সব কেবিনেট। বড় বড় আলমারি কেমন যেন সব সাজানো। আপুর কোন ছোঁয়া নেই। জানলাও নেই কারণ সব দিকে এসি। 

এই রুম টা দুলাভাইয়ের।কেমন যেন আপুর মনে হয় না আমার। এই রুম টা নাকি আগে দুলাভাইয়ের বড় বোনের ছিলো। 


আমি আর কখনো মাছের মাথা নিয়ে আপুর শশুড় বাড়ি যাই নি। 


অনেক বছর পর এক সকালে আপুর রুমটা চেঞ্জ হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলে,

 বাবা বলে, 

-তোর জন্য নতুন খাট আর আলমারী বসানো হচ্ছে। 

-কেন? 

- কেন মানে? বিয়ের পর তুই কি তোর ঐ গুদাম ঘরে থাকবি নাকি? এখন থেকে তোর রুম এইটা। 


আমার রুম? না আমি মানতে পারি না। আমার মনের মাঝে অজান্তে এইটা আপুর রুমেই জানি।

 মা আমাকে মাঝে মধ্যে বলে,

- তোর রুম থেকে জিনিসটা নিয়ে আয়।

আমি সারাঘর খুঁজে আসি। শেষে মা বলে

 - আরে গাধা তোর আপুর রুমে। 

-হুম। আপুর রুম এখন যা আমার রুম। 


আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে আপুর সব কিছু। মা এখন আপুর ফেলে যাওয়া ওরনা গুলো দিয়ে কাথা কম্বল ঢেকে রাখে৷ ওর সেলোয়ার কামিজ এখন ফ্লোরে পানি পড়লে উইজ করা হয়। হারিয়ে যাচ্ছে ওর ছোঁয়া এই ঘরের থেকে। 


রুমটাতে এখন আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। মিতু ও সব গুছিয়ে রাখে। তবে সে যেন টানটান ভাবটা নেই। তবে এখন কামীনি ফুলের সুবাস ছড়ায় এই রুমে। 


এক দুপুরে খেতে বসলাম। তখন বেল বেজে উঠে। অয়ন এসেছে। অয়ন আর মিতু পিটেপিটি ভাই বোন। খুব মারামারি করত। 

একবার মিতুর হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল মারামারি করে। 


- অয়ন, আয় আয়।  

- মা একটা মাছের মাথা পাঠিয়েছিল মিতুর জন্য। 

আমি হেসে বলি, 

-মামী পাঠিয়েছে নাকি তুই এনেছিস?

মিতু তুমি মাছের মাথা খেতে ভালোবাসো বলো নি কেন? 

- না মানে তুমি খাও তো। 

-আরে আমি তো কেউ খায় না তাই খাই। এখন থেকে তুমি খাবে।


আমি রুমে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। টেবিল থেকে অয়ন আর মিতুর হাসির শব্দ হচ্ছে। আসলে কি অদ্ভুত পবিত্র হয় ভাই-বোনের সর্ম্পক গুলো তাই না? 


বিশ বছর পর। বাসায় চিৎকারের শব্দ। এখন বাবা মায়ের রুম টা আমাদের রুম। আমি রুম থেকে বের হই, আমার ছেলে অর্ক চোখ মুছতে বের হচ্ছে। 

-কি রে কি হয়েছে? 

-আপুর রুমে শুয়েছিলাম। আপু মেরে বের করে দিয়েছে। 

আমি বিড়বিড় করে বলে উঠলাম, 

-আপুর রুম? 

যেন অনেক বছর পর কারো সাথে দেখা এমন লাগল শব্দটা৷ 

আমি সে রুমে গেলাম। এইটা এখন আমার মেয়ে পারুলের রুম। সব দিক যেন সে টানাটানা গুছানো ভাব টা আছে এখন। আর আমার নাকে হঠাৎ সেই কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধটা লাগলো।


--------সমাপ্ত------


গল্পঃ_আপুর_রুম 

লেখনীতে : দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা


এমন আরও গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post