বাস্তব জীবনের গল্প
আমার একটা ছোটবোন আছে, ওর নাম তিতলি। আমি আদর করে ডাকি টিকলি। টিকলি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে অর্থনীতিতে পড়ছে।
কিছুদিন আগে টিকলি ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফিরে রোজ রোজ সে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
" ভাইয়া আসবি কবে?"
আমি যাব যাব করেও আর যেতে পারছি না। সারাদেশের মানুষদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছি। সবাইকে বাড়ি পৌঁছে না দিয়ে নিজে বাড়ি ফিরি কি করে! তারপরও ফেরা যেত, কিন্তু চাকরি থাকবে না।
আমি ছোট একটা চাকরি করি, গাড়ির সুপারভাইজার। গতকাল বিকেলে বেনাপোল থেকে ঢাকায় ফিরেছি। ফেরার কথা ছিল সকাল আটটার মধ্যে, সকাল নয়টায় দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল। রাস্তায় লাগাতার জ্যামের কারণে সময়মতো ফেরা হয়নি। ঢাকায় ফিরতেই দুপুর একটা বেজে গেল। গাড়ি পরিস্কার করে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা হতে হতে দুপুর দুইটা বেজে গেছে। আমিনবাজারের পর থেকে শুরু হয়েছে টানা জ্যাম। গাড়ি এগুচ্ছে পায়ে হাঁটা গতিতে।
টিকলির সাথে সর্বশেষ আমার দেখা হয়েছিল মাসখানেক আগে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ও আমাকে রিকশায় করে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। সারাটাদিন ওর সাথে কাটিয়ে ফেরার সময় জিজ্ঞাসা করলাম,
'টাকা-পয়সা কেমন লাগবেরে?'
বোনটা আমার বলল, 'আমার কিছু লাগবে না ভাইয়া। তোমার কি কি লাগবে বলো তো? একটা লিস্ট করে দিয়ে যাও আমাকে।'
পড়াশোনার পাশাপাশি টিকলি কোথায় কোথায় যেন পড়ায়। সেখান থেকে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা-পয়সা সে পায়। ছোটবোন তো ছোটবোনই, সে পৃথিবীর সবথেকে ধনী হলে গেলেও বড়ভাইয়ের কাছ থেকেই নিতে হবে—এমনটাই তো নিয়ম। আমি পাঁচ হাজার টাকা জোরপূর্বক দিয়ে এসেছিলাম।
গাড়ির শেষের দিকে কি নিয়ে যেন হৈচৈ লেগেছে। দুজন প্যাসেঞ্জার উঠে এসেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
'স্যার কি হয়েছে?'
দুজনই বিরক্তমুখে বলল,
'একজন বমি করে ভাসিয়েছে ভাই। গন্ধে টিকতে পারতেছি না।'
এসি বাসের এই এক সমস্যা। গাড়ির ভেতরে বমি করলে পুরো গাড়ি গন্ধে ভরে যায়। সবাইকে আলাদাভাবে পলিথিন দেওয়া হয়, কিন্তু বেশিরভাগ ট্রিপে দুই-একজন এমন যাত্রী পাওয়া যায় যারা পলিথিনে বমি না করে সিটের সামনেই করে দেয়।
যিনি বমি করেছেন তিনি একজন মধ্য বয়সী মহিলা। বমি করে তিনি নিজেও পড়েছেন লজ্জার মধ্যে। জ্যামের কারণে ঘণ্টাখানেক থেকে একই জায়গায় গাড়ি থেমে আছে। যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে হেলপারকে দিয়ে গাড়ি পরিস্কার করালাম। এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে আমি নিজেও গাড়ি থেকে নামলাম।
রাত বাজে সাড়ে তিনটা। তেরো ঘণ্টায় মাত্র বগুড়া পর্যন্ত আসতে পেরেছি। প্যাসেঞ্জারদের ঈদ আজ গাড়িতে বসেই কাটবে। কেউই ঈদের জামায়াত পাবে বলে মনে হয় না। টাকা-পয়সা খরচ করে এত কষ্ট, এত শত কিলো পথ পাড়ি দিয়ে তবুও নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। প্রিয়জনদের মুখ দেখলেই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে, সব কষ্ট সার্থক হবে।
দিনাজপুরে পৌঁছতে সকাল এগারোটা বেজে গেল। গাড়ি গ্যারেজ করে আমি বাড়ির পথে রওনা হলাম।
আমাদের বাড়ি দিনাজপুর বালুবাড়ি শহীদ মিনার রোডে। ঈদ উপলক্ষে টিকলি, মা আর স্ত্রীর জন্য শাড়ি কিনেছি।
টিকলির একটা ভালো ফোন দরকার ছিল। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম একটা ভালো ফোন ওকে কিনে দেব, কিন্তু পারছিলাম না। এবার ওর জন্য একটা ফোন কিনেছি। ফোনটা ওর পছন্দ হবে কি না বুঝতে পারছি না।
বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই মা এসে দরজা খুলে দিল। টিকলি আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
"ভাইয়া।"
সপ্তাহখানেক থেকে ঠিকমতো থেকে গা-গোসল নেই, ঘুম হচ্ছে না। বোনটাকে দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মা'র সহজ-সরল গলার স্বর,
'তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়।'
আমি বললাম, 'মা ঘণ্টা দুয়েক পরেই কিন্তু আমি আবার বের হবো।'
মা অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'মাত্রই না এলি!'
- ডিউটি আছে মা।
- আচ্ছা, জলদি গোসল করে আয়।
গত চারবছরে কয়টা ঈদে বাড়িতে এসেছি বলতে পারি না। দেশের সব প্রতিষ্ঠান ঈদে বন্ধ থাকলেও পরিবহন তো বন্ধ থাকে না। বন্ধ থাকুক তাও চাই না, পরিবহন বন্ধ থাকলে মানুষ ঈদে বাড়ি ফিরবে কি করে! তাছাড়া কিছু বাড়তি রোজগার হয়। আমাদের মতো দরিদ্রপীড়িত পরিবারে অর্থের চাহিদা মহামারির মতো। কতকাল আর পরিবার-পরিজন ছেড়ে গাড়ি থেকে গাড়িতে রাত-দিন কাটাব! খুব বেশিদিন আর চাকরিটা করার ইচ্ছা নেই। তাই ব্যবসার জন্য কিছু করে টাকা জমাচ্ছি।
বাবা বেঁচে থাকতে প্রতিবছর হাট থেকে ঈদের কয়েকদিন আগেই গরু কিনে আনতাম। বাপ-বেটা মিলে ঈদের দিন গরু বানাতাম। কালের স্রোতে গত চারবছর থেকে কোরবানি দেওয়া হয় না। এ বছর টিকলি নিজের টাকায় কোরবানির ব্যবস্থা করেছে। চাচাদের সাথে ভাগে একটা গরু নিয়েছে। গরু কাটা এখনো শেষ হয়নি। এরমধ্যে চাচা কিছু মাংস পাঠিয়ে দিয়েছে। মা রান্না বসিয়েছে।
আমি ব্যাগ থেকে টিকলি, মা আর স্ত্রীর জন্য কেনা শাড়ি বের করলাম। মাকে শাড়ি দিতেই মা বলল, 'আবার শাড়ি এনেছিস কেন?'
স্ত্রীর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। টিকলি শাড়ি দেখে বলল, 'ওয়াও! এত সুন্দর।'
আমি আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আমার পেছন পেছন স্ত্রী এসে বলল, 'আজ কি যেতেই হবে?'
আমি হেসে বললাম, 'না গেলে চাকরি থাকবে?'
স্ত্রী খানিকটা রাগ হতে পারত, কিন্তু দুপুর দুইটার দিকে আবারও ঢাকার উদ্দেশে চলে যাব। রাগ করার সময় কোথায়! এরমধ্যে টিকলি একটা পাঞ্জাবী আর একটা জিন্সের প্যান্ট এনে আমার হাতে দিয়ে বলল,
'ভাইয়া এগুলো তোর। পরে নে।'
আমি বললাম,
'তুই এসব কিনেছিস কেন?'
- বারে তুই কিনিস কেন? পরে নে।
আমি গোসল সেড়ে টিকলির দেওয়া পাঞ্জাবী আর জিন্সের প্যান্ট পরে ঘর থেকে বের হলাম। টিকলি আমাকে দেখে বলল, 'আমার ভাইটাকে কি সুন্দর লাগছে!'
এরপর ওর ভাবিকে ডেকে বলল, 'ভাবি দেখো, তোমার জামাইকে সুন্দর লাগছে না?'
স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে লাজুক হাসি দিল। আমার কেমন যেন লজ্জা লাগতে শুরু করল।
মা টেবিলে খাবার দিয়ে ডাকতে শুরু করেছে। আমি টিকলি আর স্ত্রীকে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি টিকলিকে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো মুঠোফোনের বক্সটা দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গাড়িতে যাত্রী মাত্র আটজন। হেলপার ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে গান ছেড়ে আয়েশ করে পান চিবাচ্ছে। ড্রাইভার সাহেব গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে মেলাতে গাড়ি চালাচ্ছেন।
আমি একটা ফাঁকা সিটে গিয়ে বসলাম। পরিবার-পরিজন ছেড়ে শত শত কিলো দূরে চলে যাচ্ছি। আবার কবে দেখা হবে জানা নেই, হয়তো কাল অথবা অনেকদিন পর।
রংপুর থেকে আরো দুজন যাত্রী উঠল। গাড়ি বগুড়া মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা ফোনটা কেঁপে উঠল। আমি ফোন বের করে দেখলাম, টিকলি একটা মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজে লেখা,
'I love you vaia'
গাড়ি থেকে গাড়িতে, পথে পথে রোমাঞ্চকর জীবনের ষোল আনায় মৃত্যুর হাতছানি নিয়ে ছুটে চলার এই তো সার্থকতা।
'পরিবহন শ্রমিক'
~ নাহিদ হাসান নিবিড়