মিথ্যা ভালোবাসা স্ট্যাটাস
আজ দুপুরে সেলিম আঙ্কেল আমার বু*কে হাত দিয়েছিলেন।মা তখন অফিসে। বৃহস্পতিবার আমার কলেজ হাফ ডে থাকে। সেলিম আঙ্কেল জানেন।
সেলিম আঙ্কেলের সঙ্গে মা’র বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এ কারণে সেলিম আঙ্কেল হুট করে ভরদুপুরে বাড়িতে আসায় আমি খুব বেশী অবাক হইনি।এ রকম উনি আগে করেননি, কিন্তু দুদিন বাদে তো ওই একসঙ্গেই থাকতে হবে।
.
সেলিম আঙ্কেল শাহবাগ থেকে আমার জন্য ড্যান ব্রাউনের নতুন উপন্যাস কিনে এনেছেন। ওটা দেখে আমার ধারণা হলো মা’ই হয়তো হবু মেয়ের সঙ্গে আইস ব্রেকিং-এর জন্য সেলিম আঙ্কেলকে পাঠিয়েছেন। সেলিম আঙ্কেলের মত প্র-অ্যাক্টিভ মানুষের পক্ষে এখুনি পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেয়া মোটেও অস্বাভাবিক না।
সেলিম আঙ্কেল এসেই মা’র গল্প আরম্ভ করলেন। মা বিয়েতে কী রকম গহনা পছন্দ করবে, মাথায় ঝাঁপটা, সিতাপাটি নাকি টিকলি পরবে সেই গল্প করতে করতে সেলিম আঙ্কেল হঠাৎ পেছন থেকে দু হাত দিয়ে আমার দুই স্ত'/ন চেপে ধরলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেলাম।
প্রথমে ভাবলাম হয়তো উনি খেয়াল করেননি। হয়তো কোথাও একটা ভুল হয়েছে। কিন্তু যখন উনি হাতের মুঠো আরো শক্ত করলেন, আমি ভয়ে কুঁচকে গেলাম। নিজের অজান্তেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টান মে রে ওনার হাত সরিয়ে দিলাম। তারপর দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি দরজা লক করে দিলাম।
সেলিম আঙ্কেল আমার পেছন পেছন ছুটে এসে বাইরে থেকে বললেন,
-- 'মেঘলা, প্লিজ, একটা কথা শোন। আমি সেঁজুতিকে চাই না। আমি তোমাকে চাই।'
সেঁজুতি আমার মায়ের ডাক নাম। সেলিম আঙ্কেলের কথা শুনে প্রবল ঘৃ*ণায় আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। আমি বেসিনের কাছে গিয়ে গলা উগড়ে ব*মি করে দিলাম। সেলিম আঙ্কেলে ওদিকে দরজায় ধাম ধাম করে বাড়ি দিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল এই বুঝি দরজা ভে*ঙ্গে ভেতরে ঢুকে যাবেন।
.
আমার বাবা ফেরেশতার মত মানুষ ছিলেন। প্রেমময়, মায়াময় একজন মানুষ। আর তাকে সরিয়ে কিনা এই লোকটাকে ধীরে ধীরে মনের ভেতর বাবার আসন দিচ্ছিলাম। ছিঃ। আমার কান্না চলে এলো।
কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললাম,
-- 'প্লিজ, আপনি এখান থেকে চলে যান। না হলে আমি জানালা দিয়ে দারোয়ান চাচাকে ডাকব, পুলিশে ফোন করব।'
সেলিম আঙ্কেল তাও ইন্সিস্ট করলেন,
-- 'প্লিজ, মেঘলা, একবার বেরিয়ে আসো। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। হঠাৎ নিজের উপর কন্ট্রো*ল হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি কথা দিচ্ছি আর তোমার গা ছোঁ*ব না। লেটস কিপ ইট বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি।'
আমি এবার রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
-- 'আপনি না গেলে আমি এখুনি পুলিশে ফোন করছি।'
এবার সেলিম আঙ্কেল উত্তেজিত হয়ে বললেন,
-- 'আহ, মেঘলা, সামান্য একটা ব্যাপার এত সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেন? আমি জাস্ট ফান করেছি। টেক ইট ইজি প্লিজ।'
-- 'আমি এখন ফোন করছি।'
-- 'ওকে, ওকে, আমি গেলেই যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে তাই যাচ্ছি। শুধু একটা কথা… '
সেলিম আঙ্কেল এখন সেন্টিমে-ন্ট খেলাচ্ছেন। ওনার কথার সুর শুনে মনে হচ্ছে আমিই বুঝি কোন দোষ করেছি আর উনিই ভি*ক্টিম।
আমি বিবমিষা নিয়ে ওনাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম,
-- 'প্লিজ, আর কথা বলবেন না, যান এখুনি।'
সেলিম আঙ্কেল গ*ন্ডারের মত গরগর করে বললেন,
-- 'ব্লাডি হেল, এটা নিয়ে আর কথা বাড়িও না বলে রাখলাম। কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।'
.
মিনিট খানেক পর ঠাস করে দরজা বন্ধের শব্দ হলো। বাথরুমের জানালা দিয়ে দেখলাম সেলিম আঙ্কেল গাড়ি নিয়ে শা করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বাথরুম থেকে ড্রইংরুমে এসে বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলাম। তারপর অবসন্ন হয়ে সোফায় বসলাম।
সোফার পাশে টেবিলের উপর সেলোফিনে মোড়ানো একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। সেলিম আঙ্কেল মা’র জন্য এনেছেন। প্রায়ই আনেন। একবার মনে হলো ওগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেই। তারপর ভাবলাম ফুলের তো কোন দোষ নেই, তা ছাড়া ওগুলো তো আমার জন্য আনেননি। ফুলদানিতে ফুলগুলো গুছিয়ে রাখলাম।
.
সামনের দেয়ালে বাবার একটা ছবি ঝোলানো। আমার বাবা মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে গাড়ি এক্সি*ডেন্টে মা*রা গেলেন। তখন মা*র বয়স কত হবে,এই বড় জোর ছাব্বিশ সাতাশ। আমি বোধহয় ক্লাস ওয়ানে পড়ি। মা প্রথম প্রথম কেমন পা*গলের মত হয়ে গিয়েছিল। আর বিয়েথা করেনি। নানুকে দেখেছি কত প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, মা ফিরিয়ে দিয়েছে। মা হয়তো আমার কথাও ভেবেছে। গত দশ বছর ধরে ওই অর্থে মা পুরুষ-বিবর্জিত।
কলেজে ওঠার পর থেকে মা’র জন্য আমার মায়া বেড়ে গেছে। আমি আস্তে আস্তে মা’র স্যাক্রিফাইসটা বুঝতে শিখেছি। মা’র সঙ্গে প্রায়ই ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করেছি মা যেন আরেকটা বিয়ে করে। আমি নিজেও তো বড় হয়ে যাচ্ছি। এক সময় হয়তো আমারও ঘর সংসার হবে। মা কারো গলগ্রহ হয়ে থাকবার মানুষ না। তাহলে বাকি জীবনটা মা কী করবে? একা একাই কাটাবে?
সেলিম আঙ্কেল মা’র আগের অফিসের কলিগ। ডিভোর্সড। অনেকদিন ধরে নাছোড়বান্দার মত মা’র পিছে লেগে আছে তো লেগেই আছে। শেষমেশ অনেক জড়াজড়ির পর মা ওনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। সেলিম আঙ্কেলকে এতদিন ভালোই লাগতো। চটপটে, স্মার্ট লোক। বলার আগেই সব কিছু বুঝে ফেলেন। মনে হয়েছিল উনি মাকে আসলেই কেয়ার করেন। মা ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে সুখী হবে।
আজ হঠাৎ করেই সেলিম আঙ্কেলের মুখোশটা খসে পড়েছে।
মা বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যাবেলা। ঘরে ঢুকেই মা নিজের অজান্তেই গুন গুন করে গান ধরেছে, ‘এসো নীপবনে ছায়া বীথিতলে। আহা কতদিন পর মায়ের মুখে গান শুনছি।’
মা’কে ইদানীং আর আগের মত ক্লান্ত, অবসন্ন লাগে না। এতদিন একা একা আমাকে বড় করে, অফিস আর ঘর এক হাতে সামলে মা নিজের জীবনটাকে জা*রাজা*রা করে ফেলেছিল। তারপরও আমার ধারণা মা’র আসল ক্লান্তিটা ছিল মনের।
বেড রুমে গিয়ে মা বললো,
-- 'মেঘলা, এদিকে আয় একটু।'
মায়ের কাছে যেতেই মা ব্যাগ থেকে দুটো সিল্ক শাড়ি বের করে বললো,
-- 'মেঘলা, দ্যাখ, খান ব্রাদার্স থেকে দুটো শাড়ি এনেছি ম্যাচিং করে। তোর কোনটা পছন্দ? দুজন কাল সন্ধ্যায় শাড়ি পরে বের হবো।'
-- 'কাল কোথায় যাচ্ছি মা?'
-- 'কেন, ভুলে গেলি? কাল না তোর সেলিম আঙ্কেল ইনভাইট করেছে।'
সেলিম আঙ্কেলের কথা বলতে বলতে মা’র গাল দুটো কেমন গোলাপী হয়ে গেলো, মনে হলো ব্লাশন দিয়েছে। আহা কত বছর মার মুখে এমন লজ্জাভ গোলাপী আভা দেখি না।
.
একটু পর আমরা খেতে বসলাম। খেতে খেতে মা রাজ্যের গল্প করলো।অফিসে নতুন বস এসে কী করছে না করছে, কার প্রমোশন নিয়ে কী ঝামেলা বেঁধেছে। মনে হলো মা যেন খইয়ের মত ফুটছে। অনেক দিন ধরে আমাদের বাসায় সব কিছু নিয়মমাফিক চলছে, কিন্তু কোথায় যেন একটা আনন্দের অভাব, কী একটা নাই নাই ভাব। শুধু ইদানীং মা’র আহলাদি আচরণে মনে হয় শরৎ, হেমন্ত আর শীত পেরিয়ে এ বাড়িতে বসন্ত এসে গেছে।
রাতের খাবার সেরে মা ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুল টেনে বসলো। একটা কাঠের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমার দিকে ফিরে বললো,
-- 'এই মেঘলা, তুই তো খেয়ালই করিস না।'
-- 'কী মা?'
-- 'আমার সবগুলো চুলের আগা ফে*টে কেমন দুভাগ হয়ে গেছে।'
আমি কাছে গিয়ে মার চুলে হাত দিয়ে বললাম,
-- 'তাই তো মা, তুমি নিজেও তো নিজের খেয়াল করো না।'
মা মহা উৎসাহ নিয়ে বললো,
-- 'এখন থেকে করবো। ক্যাস্টর অয়েল কিনতে হবে। তুই এক কাজ করে, আপাতত কেঁ*চি দিয়ে চুলগুলো আধ ইঞ্চি কিম্বা এক ইঞ্চি ছোট করে কেটে দে।'
আমি বললাম,
-- 'মা ওটা পার্লারে গিয়ে করলে ভালো হতো না? ওরা প্রফেশনালি কে*টে দেব। আমি কা*টলে দেখবে এক পাশ বড়, আরেক পাশ ছোট হয়ে গেছে।'
-- 'ধুর, খামোখা পার্লারে গিয়ে অতগুলো টাকা ঢালবো কেন? এই ধর কেঁচি, তুই কাট, একটু সাবধানে কা*টিস।'
আমি মা’র চুল পিঠের পেছনে সমান করে বিছিয়ে খুব সাবধানে কেঁচি দিয়ে কাটছি। মা আয়নায় নিজেকে দেখছে আর গুন গুন করে গাইছে, ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে, স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে, মুগ্ধ এ চোখে।’
এতগুলো বছর পর মা আবার স্বপ্ন দেখা আরম্ভ করেছে।
মা’কে আমি কীভাবে বলি সেলিম আঙ্কেলের ঘটনা?
গল্পঃ মায়ের বিয়ে
প্রথম পর্ব : (০১)
-----------
গল্পঃ মায়ের বিয়ে
শেষ পর্ব : (০২)
-----------
আজ সেলিম আঙ্কেল দাওয়াত করেছেন। আমি আর মা দুজনেই কালো সিল্কের উপর সোনালী পাড় আর সোনালী সুতোর কাজ করা শাড়ি পরেছি। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমরা দু’বোন।
ধানমন্ডির ওই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে উবারে গেলেই ভালো হতো, কিন্তু আমরা রিক্সা নিয়েছি। ইদানীং সন্ধ্যাগুলো ভারী চমৎকার। আবছায়া স্ট্রিট লাইটের আলোয় প্রাণ হায় হায় করা বাতাস গায়ের উপর দিয়ে বয়ে যায়। মনটা কেমন করে ওঠে ।
রিক্সায় পুরোটা পথ মা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল, আমি যে তার নাড়িছেঁড়া ধন।
.
আধঘণ্টা পর রেস্টুরেন্টে ঢুকেই কেমন একটা ঘোর লাগা অনুভূতি এলো। চকচকে কাঠের ফ্লোর, সিলিঙে দামী ঝাড়বাতি, বাদামী মলখমলে আবৃত চেয়ার। এমন পশ রেস্টুরেন্টে আগে কখনো আসিনি। নারী দিবস বলে কিনা জানি না, রেস্টুরেন্টের প্রায় সবগুলো টেবিল মানুষে ভরে গেছে। অনেক মেয়ে বেগুনী শাড়ি পরে আড্ডায় মেতেছে।
জানালার কাছে একটা গোল ফোর-সিটার টেবিলে সেলিম আঙ্কেল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা কাছে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পারফেক্ট জেন্টলম্যানের মত সেলিম আঙ্কেল আমাদের চেয়ার পেছনে সরিয়ে দিলেন। আমরা চেয়ার টেনে বসলাম। সেলিম আঙ্কেল উল্টো দিকে বসলেন।
নেভি ব্লু রঙ্গের শার্ট আর কালো ফর্মাল ট্রাউজারে সেলিম আঙ্কেলকে খুব শার্প লাগছিল। মা’র দিকে তাকিয়ে সেলিম আঙ্কেল মৃদু হেসে বললেন,
-- 'সেঁজুতি, আমি খুব খুশী হয়েছি তোমরা মা মেয়ে দুজনই আসতে পেরেছো। আর কালো শাড়িতে তোমায় কী যে গর্জিয়াস লাগছে, আমি বলে বোঝাতে পারবো না।'
মা উত্তরে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।
সেলিম আঙ্কেল এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- 'আর মামণি তোমাকে আজ একটা রূপকথার রাজকন্যার মত লাগছে। সাচ অ্যা প্রেটি ই*য়াং গার্ল।'
কথা বলতে বলতেই সেলিম আঙ্কেল টেবিলের নীচ দিয়ে আমার পায়ের উপর পাড়া দিলেন। আমি ত্রস্ত হয়ে পা সরিয়ে নিলাম। ওয়েটার এসে মেনু দিলো। মা যখন মেনু দেখছিলেন, সেলিম আঙ্কেল আমাকে চোখের নজরে চাখছিলেন। আমার পুরো শরীর মন ঘিন ঘিন করছিল।
.
মা’র বিয়ের পর আমাদেরকে সেলিম আঙ্কেলের ধানমন্ডির বাসায় উঠতে হবে। এ জন্য সেলিম আঙ্কেল বাড়ির রেনোভেশন করাচ্ছেন। এই মুহূর্তে ইন্টেরিওর ডিজাইনার দিয়ে কিচেন ফিট আউট করছেন। মা’কে একবার গিয়ে দেখে আসতে হবে। এসব গল্প করতে করতে খাবার চলে এলো।
আমাদের পাশের টেবিলে একটু আগে দুজন তরুণী এসে বসেছে। দুজনেই শার্ট আর জিন্স পরা, সুঠাম আকর্ষণীয় গড়ন। সেলিম আঙ্কেল চাউমিন খেতে খেতে মাঝে মাঝেই সেদিক চোখ মারছিলেন। ওদের একজন দেখলাম চকিতে সেলিম আঙ্কেল দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। সেলিম আঙ্কেলের মুখে কেমন একটা ছনমনে হাসি ফুটে উঠলো।
মা সেটা না বুঝে জিগ্যেস করলো,
-- 'কী সেলিম, হঠাৎ হাসলে কেন?'
-- 'না, অফিসের একটা ঘটনা মনে পড়লো হঠাৎ, অন্য সময় বলবো।'
মা ডিনার শেষ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললো,
-- 'সেলিম, একটা কথা বলতে পারি?'
-- 'হ্যাঁ, সিজিমণি, কেন না? আমার কান তো তোমার কথার ভিখারি।'
-- 'মেঘলার বাবা হঠাৎ মা*রা যাবার পর আমি অকূল পাথারে পড়েছিলাম। তারপর তো জানো একা একা কত কষ্টে মেঘলাকে মানুষ করেছি। মেঘলাই আমার পৃথিবী।'
-- 'ইস, তখন যদি আমাদের পরিচয় থাকতো, আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারতাম, মেঘলাকে নিজের হাতে মানুষ করতাম। মেঘলা তো আমারও পৃথিবী!'
বলতে বলতে সেলিম আঙ্কেল টেবিলের নীচ দিয়ে আমার পায়ে আবার পাড়া দিলেন। আমি পা সরিয়ে নিলাম।
মা সেলিম আঙ্কেলকে বললো,
-- 'তখন তো তোমার আগের বউ ছিল, সিমি?'
-- 'হ্যাঁ, থাক না সে কথা, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?'
-- 'আরেকটা কথা বলি, রাগ করবে না তো?'
-- 'কী?'
-- 'সিমির সাথে আজ ভোরে কথা হয়েছে, সে তো এখনো তোমার আগের অফিসেই চাকুরী করে।'
সেলিম আঙ্কেলের চেহারা দেখে মনে হলো কোথাও একটা ছন্দ পতন হয়েছে।
শুকনো কন্ঠে বললেন,
-- 'হঠাৎ সিমি কেন? ব্যাঙ্ক লোনের ব্যাপার নাকি? আমাদের ব্যাঙ্কে তো ইন্টারেস্ট রেইট কম, আর এখন ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কী করবে? আই উইল টেক কেয়ার অফ ইউ।'
-- 'আরে না,না, ব্যাঙ্ক লোনটন না।'
-- 'তাহলে কী?'
-- 'এই যে তোমাকে বিয়ে করব, তুমি মানুষটা কেমন আরেকটু জানতে হবে না?'
সেলিম আঙ্কেল মুখ গম্ভীর করে বললেন,
-- 'কী বললো সিমি?'
-- 'উল্টোপাল্টা কথা, তুমি নাকি ছোট ছোট মেয়েদের গা*য়ে হাত দিতে, বিশেষ করে কাজের মেয়েদের… '
সেলিম আঙ্কেল এবার উত্তেজিত কিন্তু চাপা স্বরে বললেন,
-- 'আমি তোমাকে বলেছিলাম না সিমি একটা বিচ আন্ড লায়ার, স্যরি ফর মাই ব্যাড মাউথ।'
-- 'সিমি না হয় মিথ্যা বলেছে, আমার মেয়েও কি মিথ্যা কথা বলে?'
-- 'কে? মেঘলা? ও আবার কী বলে?'
-- 'কাল দুপুরে তুমি কী করেছ ওর সঙ্গে?'
ওয়েটার বিল নিয়ে এসেছে। সেলিম আঙ্কেল পারফেক্ট জেন্টলম্যানের মত ওয়েটারকে বিল শোধ করে অনেকগুলো টাকা টিপস দিলেন। ওয়েটার খুব খুশী হয়ে স্যার স্যার বলে চলে গেলো। সেলিম আঙ্কেল কম্পোজার না হারিয়ে ঠান্ডা গলায় মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- 'সেঁজুতি, সিজি আমার, তাহলে সত্য কথা বলি, যদিও বলতে চাইনি।'
-- 'কী সত্য কথা?'
-- 'মেঘলা কাল আমায় সিডিউজ করার চেষ্টা করেছে। শি ট্রায়েড টু টেক মি টু ইওর বেড। আমি কোন রকমে ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে র*ক্ষা পেয়েছি। আর কী বলেছে জানো?'
-- 'কী?'
-- '‘আমি থাকতে আপনি মাকে বিয়ে করতে চান কেন?’, চিন্তা করতে পারো সিজি কেমন ডিরেইল্ড হয়ে গেছে এই মেয়ে? বাট ডোন্ট ওরি, আই উইল ফিক্স হার।'
-- 'তুমি আর কোন দিন আমার বাড়িতে আসবে না।'
-- 'কী?'
-- 'লম্পট কোথাকার, আর কখনো আমার বাড়িতে আসবে না।'
সেলিম আঙ্কেল কিছু বললেন না, কয়েক মুহূর্ত আমার আর মা’র দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর চোখা ঠান্ডা করে মা’কে বললেন,
-- 'সেঁজুতি, সিজি আমার, একটা কথা বলি?
-- 'বলো।'
-- 'আমার এক বন্ধু ছিল। যার সঙ্গেই সে প্রেমে ব্যর্থ হতো সবাইকে বলে বেড়াতো সে তার সঙ্গে বেডে গেছে। মেয়েদের ক্যারেক্টার অ্যাসাসিন করে ছেড়াবেড়া করে দিতো।'
-- 'আমাকে এ কথা বলছো কেন?'
-- 'আমি কী বলে বেড়াবো জানো?'
-- 'কী?'
-- 'তোমাদের মা মে দুজনকেই আমি বিছানায় নিয়েছি। দেখবো তুমি আর তোমার ছেনাল মেয়ে কীভাবে সমাজে টিকে থাকে।'
সেলিম আঙ্কেল এমনভাবে হেসে হেসে বলছিলেন কথাগুলো, দূর থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে একটা ডিসেন্ট ফ্যামিলি একসঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাচ্ছে। আমার দু’কান গরম হয়ে গেলো। মা সেলিম আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে ম্লান কন্ঠে বললো,
-- 'বুঝেছি।'
সেলিম আঙ্কেল পকেট থেকে একটা এঙ্গেজমেন্ট রিং নিয়ে মা’র দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন,
-- 'গুড গার্ল, নাও এটা আঙ্গুলে পরে নাও।'
-- 'এক মিনিট।'
মা এনগেজমেন্ট রিং হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রেস্টুরেন্টের গেস্টদের দিকে তাকিয়ে একটা কাচের গ্লাসে চামচ দিয়ে টুং টুং শব্দ করে বললো,
-- 'প্লিজ, সবাই একটু শুনুন, আজ নারী দিবসের সন্ধ্যায় আমি একটা ঘোষণা দিতে চাই।'
অনেকেই চেয়ার ঘুরিয়ে মা’র দিকে তাকালো। বিদেশের অনুকরণে ইদানীং এই ট্রেন্ড চালু হয়েছে, সবার সামনে এনগেজমেন্টের ঘোষণা। সেলিম আঙ্কেল আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বললেন,
-- 'একটু ভয় খাওয়াতেই লাইনে চলে এসেছে তোমার মা।'
আমি অসহায় চোখে মা’র দিকে তাকালাম।
মা বলছেন,
-- 'আমার পাশে যেই ভদ্রলোককে দেখছেন আপনারা, এনার নাম সেলিম চৌধুরী।'
সবাই এখন কৌতুহল নিয়ে সেলিম আঙ্কেলের দিকে তাকালো। মা সেলিম আঙ্কেলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
-- 'সেলিম, বসে কেন, উঠে আমার পাশে এসো।'
সেলিম আঙ্কেল মা’র পাশে এসে দাঁড়ালেন। সবার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে হাত নাড়লেন। এবার মা আমাকে দেখিয়ে বললো,
-- 'আর এই হলো আমার মেয়ে, মেঘলা।'
আমি লজ্জা পেলাম কারণ সবাই একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মা বললো,
-- 'এখন আমার ঘোষণা শুনুন প্লিজ।'
সবাই জানে কী ঘোষণা আসবে, অনেকেই হাততালি দেবার জন্য দু হাত সামনে নিয়ে এসেছে। মা বললো,
-- 'এই সেলিম চোধুরী একটা জ*ঘন্য পি*ডোফাইল এবং রে*পিস্ট। কাল দুপুরে সে আমার মেয়েকে রে*প করার চেষ্টা করেছিল। আমি অফিসে ছিলাম। ভাগ্য ভালো আমার ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। আমি পুলিশে ভিডিও জমা দিয়েছি। আপনারা সবাই দোয়া করবেন এই পি*শাচের যেন ভয়ঙ্কর শাস্তি হয়।'
লোকজনের মুখে এখন ফিসফিসানি, চারিদিকে কেমন একটা স্তব্ধ চাঞ্চল্য। সেলিম আঙ্কেলের চেহার বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেলিম আঙ্কেলকে ভেজা কাকের মত লাগছে। পাশে বসা জিন্স আর শার্ট পরা স্মার্ট মেয়ে দুটো এই মাত্র উঠে এসে সেলিম আঙ্কেলের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। এরা যে সাদা পোশাকে পুলিশের লোক সেটা একমাত্র মা জানতো।
সেলিম আঙ্কেলকে সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসাররা ঠেলতে ঠেলতে রেস্টুরেন্টের বাইরে নিয়ে গেলো। গেস্টদের করতালিতে চারিদিক মুখরিত হইয়ে উঠলো।
.
একটু পর আমি আর মা বেরিয়ে এলাম। কাল রাতেই আমি মা’কে সব খুলে বলেছিলাম। মা অনেক কেঁদেছিল, পুরনো বাড়ির মত ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু একটু পর মা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল, রাণীর মত উঠে দাঁড়িয়েছিল। দশ বছর ধরে যে মা এক হাতে আমাকে বড় করেছে সে কি এই সামান্য ঝড়ে টলবে?
.
রিক্সায় যেতে যেতে মা আবার শক্ত করে আমার হাত ধরে বললো,
-- 'তুই আমার নাড়িছেঁড়া ধন। তোকে যে খা*রাপভাবে ছোঁবে, দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক, আমার হাত থেকে তার নিস্তার নাই।'
মা একটু থেমে যোগ করলো,
-- 'কিন্তু তাই বলে ভাবিস না পৃথিবীর সব পুরুষ খা*রাপ। ঠেকে শেখা মানে কিন্তু হেরে যাওয়া না।'
---
আমরা বাড়ির কাছে চলে এসেছি। চারিদিকে মন হায় হায় করা বসন্ত বাতাস। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি মনে মনে বললাম, ‘আমার মা’ই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ, আমার মা একটা ওয়ান্ডার উম্যান।’
(সমাপ্ত)...