চরম বাস্তব কিছু তেতো কথা | বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

কষ্টের কিছু বাস্তব কথা

কষ্টের কিছু বাস্তব কথা

-মা,আমি জয়েন্টে র‍্যাঙ্ক করেছি মা।

প্রীতম এক গাল হাসি মুখে ভীষণ উৎফুল্লতার সাথে রান্না

চালার মধ্যে এসে কথাটা বলতে বলতে মাকে জড়িয়ে ধরে

গালে চুম্বন করলো।প্রীতমের মা তখন মাটির উনুনে ভাত চাপিয়ে উনুনের ভেতর জাল দিচ্ছিলো।ছেলের কান্ড দেখে


-সত্যি খোকা..তুই সত্যি বলছিস..


-হ্যাঁ গো মা।এই দেখো লিস্টে আমার নাম এসেছে।সাতশো

বারো র‍্যাংক করেছি।


প্রীতম কথাটা বলতে বলতে তার মায়ের হাতে জয়েন্ট এন্টার্ন্সের মেরিট লিস্টের প্রিন্ট কপিটা ধরিয়ে দিতে তার মা 

সেটার দিকে চেয়ে বললো-


-কোন খানটায় তোর নাম বেরিয়েছে খোকা।


প্রীতমের মা পড়াশোনা জানেনা।প্রীতম লিস্টে তার নামটা

দেখাতে তার মা অশ্রুভরা চোখে পাতায় তাদের ছেলের নামটার ওপরের চুম্বন করলো।তারপর বললো-


-তোর বাবা এসে যখন জানবে খুব খুশি হবে দেখিস।


প্রীতমের বাবা সামান্য ভাগচাষি।দুপুরে মাঠ থেকে ক্লান্ত দুই

চোখে ফিরে যখন জানতে পারলো তাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার

নিং এ সুযোগ পেয়েছে তখন তার ওই ক্লান্ত দুই চোখে অশ্রু

ভরে এসেছিলো আনন্দের।প্রীতমকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছিলো-


-আমি এবার গর্ব করে বলতে পারবো সবার কাছে যে আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে চলেছে।


-হ্যাঁ বাবা।আমি এরপর আরও ভালো করে মন দিয়ে পড়া

শোনা করে চাকরি করে তোমাদের দু:খ ঘোচাবো দেখো।


প্রীতম এত ভালো র‍্যাংক করার জন্য তার সুযোগও এসে গিয়েছিলো সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।একমাত্র ছেলে

কে একা একা শহরে পাঠাতে প্রীতমের মায়ের বিশেষ ইচ্ছে

না থাকলেও অবশেষে যেতে দিতে হয়েছিলো তাকে।


প্রীতমদের পারিবারিক অবস্থা একেবারে সচ্ছল ছিলো না।

তাই তার পক্ষে আলাদা করে মেস ভাড়া নিয়ে থাকার উপায়

ছিলোনা।তাই তাকে উঠতে হয়েছিলো কলেজের হোস্টেলে।

ওর বাবা ওকে ছাড়তে এসেছিলো কলেজে।সেদিন ওকে

কলেজের হোস্টেলে রেখে যখন মেসের দরজা থেকে বেরিয়ে আসছিলো তখন ওর বাবার মুখোমুখি হয়েছিলো 

হোস্টেলের অন্য একটা ছেলের সাথে।ছেলেটা খুব শহুরে কিন্তু আচার ব্যবহার বেশ ভালো লাগলো তার বাবার।ছেলে

টা প্রীতমের বাবাকে বললো-


-একদম চিন্তা করবেন না মেসোমশাই।আপনার ছেলের এখানে কোনো অসুবিধা হবেনা।


প্রীতমের বাবা গ্রামের লোক।সরল মনের মানুষ।ছেলেটির

কথা শুনে যেন তিনি একটু আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেন।নতুন কলেজ।প্রথম দিনের ক্লাসের শেষে প্রীতম আর একটা ছেলে নবীন।দুজনে আলাপ পরিচয় করতে করতে কলেজের ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে দেখে সব সিনিয়র

রা বসে আছে।সিনিয়রদের মধ্যে একজন তাকে ডেকে বললো-


-কী নাম?


-প্রীতম।


-বাবা কতগুলো তোর যে সারনেমটা বললিনা..


কী নিম্ন মানসিকতার প্রশ্ন।প্রীতমের খারাপ লাগায় যে জোর গলায় বললো-


-তোমার কতগুলো বাবা?


-কী বললি..এত সাহস তোর..


ছেলেটা তো উঠে তাকে চড় মারতে যায় যায় কী সকালের সেই সিনিয়র যে প্রীতমের বাবার সাথে কথা বলছিলো।ধ্রুব।

সে ছেলেটাকে-


-শোভন।বসে যা।


বলে তার হাতটা টেনে তাকে বসিয়ে দিলো।শোভন মাথা ঠান্ডা করে ফের প্রীতমকে বললো-


-যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিস তবে আজকে তোর

খাওয়া জুটবে নয়তো বন্ধ।বল,আমাদের কলেজ কবে স্থাপিত হয়েছিলো?


-উনিশশো চুয়াত্তর।


ঠিকই উত্তর দিয়েছিলো প্রীতম।তাও শোভন তাকে বললো-


-নির্দিষ্ট তারিখ নেই নাকি।সারাবছর ধরে স্থাপন করা হয়ে

ছিলো নাকি।উত্তর দিতে পারিসনি তোর খাওয়া দাওয়া সব

এবেলা বন্ধ।


এবার এক এক করে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের সব ছেলেকে

শোভন ও আরও অন্যান্য সিনিয়াররা,শুধু ধ্রুব ছাড়া নানা প্রশ্ন করতে লাগলো।একজনকে তো এটাও বললো-


-আমাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেওয়ালটাকে তুই

ঠেলে সরা এখান থেকে।


একবেলাতেই প্রীতম বুঝে গেলো এই কলেজে টিকে থাকা

সত্যিই কত কঠিন কাজ।সারাদিনটা ওই একটু জল খেয়ে

কেটে গেলো তার।হোস্টেলেও তার খাওয়ার ওপর নিষাধাজ্ঞা পড়েছিলো।পেটে খিল মেরে সারাদিনটা কাটানোর পর রাতে ঠিক খাবারটা রূমে নিয়ে এসে খেতে বসবে সেকেন্ড ইয়ারের একজন সিনিয়ার এসে বললো-


-তোদের থার্ড ইয়ার থেকে ডাকছে।এখনি চল।


তখনকার মত প্রীতমের আর খাওয়া হলোনা।বাকিদেরও।

ওপরে তিনতলার ঘরে ঢুকতেই গাঁজার গন্ধ প্রীতমের নাকে

গেলো।সে এই সব জীবনে ছুঁয়েও দেখেনি।একেই তো খালি

পেট।তার গা গুলাতে আরম্ভ করলো।শোভন তাদের সবাই

কে একসাথে দাঁড় করিয়ে এক এক করে ইন্ট্রো দিতে বলল।

সে প্রতিবারই কারোর কোথাও না কোথাও ভুল হয়ে যায়।

আর যতবার ভুল হচ্ছে তার দরুন হচ্ছে শাস্তি।শোভনের

প্রীতমের ওপর বিশেষ রাগ ছিলো।প্রীতম যতবার ভুল করছে ততবার তার পায়ের ওপর পড়ছে কাঠের বাটাম।

প্রীতম সহ্য করতে পারছে না সে যন্ত্রনা।চোখ ফেটে তার জল বেরিয়ে যায় যায়।পরিশেষে সেদিন যখন তাদের ছুটি

হলো তখন তাদের কারোর পায়ে জোর নেই যে নীচের তলা অবধি হেঁটে নামে।রাতের খাবার তাদের কারোর পেট পর্যন্ত

ঢুকলোনা।যন্ত্রনায় তাদের চোখে ঘুম নেমে এলো।পরদিন সকালা প্রীতম সবাইকে বললো-


-আমাদের প্রিন্সিপালের কাছে এদের নিয়ে কমপ্লেন করা

উচিত।


কিন্তু কেউ তার কথার সাথে সম্মতি দিলোনা।তার নিজেরও

আর একার সাহস হলোনা কমপ্লেন করতে যাওয়ার।সেদিন

ক্লাসে স্যার বেশ কিছু প্রশ্ন করলো তার উত্তর কেউই দিতে

পারলোনা।সকলের সাথে সাথে প্রীতমও স্যারের থেকে অনেক গুলো কথা শুনলো।খারাপ লেগেছিলো তার।কিন্তু

কী করবে।পড়ার সুযোগ তো হয়নি আগের দিন।ক্লাসের এক মেয়ে নাম আবৃতি।তার সাথে প্রীতমের আলাপ হলো।

তারা সেদিন ছুটির পর একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলো।আর সেটা সিনিয়রদের চোখে পড়েছিলো।

রাতে সেদিন শুধু ওর একার ডাক পড়লো ওপর ঘরে।সে গেলোনা।মাঝ রাত্রিরে সে যখন পড়ছে আচমকা কয়েক

জন সিনিয়ার এসে তাকে চ্যাংদোলা করে ওপরে তুলে নিয়ে

গেলো।নিয়ে গিয়ে তারা শোভনের সামনে তাকে যেন ফেলে

দিলো।তার কনুইয়ে খুব জোর লাগলো।সে যন্ত্রনায় অস্ফুট

আওয়াজ করে উঠলে পর শোভন তার হাতের রুলকাঠটা

দিয়ে ফটাফট কয়েকবার তার ওপর চালিয়ে দিয়ে বললো-


-পড়াশোনা করতে এসেছিস নাকি মেয়ে পটাতে এসেছিস

এখানে?আবৃতির সাথে কীসের অত পিরিতি হ্যাঁ?


প্রীতম ব্যাথাতুর গলার স্বরে শোভনকে বললো-


-ওর সাথে পড়াশোনার ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো..


-পড়াশোনা...!!আবৃতির কী দেখছিলি তুই হ্যাঁ..?পারবি তুই?

তোর ওইটার টিপ আছে..?


-কী সব বলছো দাদা তুমি?


-ন্যাকা..জানেনা..কই দেখি প্যান্ট খোল তোর..দেখি দম আছে কিনা..


সেদিন থার্ড ইয়ারের সব দাদাদের সামনে প্রীতমকে প্যান্ট খুলতে হলো।প্রীতম লজ্জায় আর মাথা তুলে তাকাতে পারলোনা।সবাই হো হো করে হাসছিলো শুধু ধ্রুব ছাড়া।


-এমন ল্যাংটা অবস্থায় প্যান্টটা হাতে নিয়ে তুই নীচের তলায় যাবি।যদি শুনেছি পরেছিস।তাহলে কাল গোটা কলেজের সামনে ল্যাংটো করিয়ে ঘোরাবো।


ভীষন অপমানিত বোধ করেছিলো প্রীতম সেদিন।সারারাত

টা নিজের বালিশে মুখ চেপে কেঁদেছিলো।পরদিনও ক্লাসে

স্যারের কথা শুনতে হলো তাকে।সে মনে মনে স্থির করেই

ফেলেছিলো কেউ না যাক সে একা গিয়ে প্রিন্সিপালকে কমপ্লেন করবে।আর সে সেটাই করলো।নবীন এই কদিনে

তার কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিলো।সে নবীনের কথা শুনলো না।প্রিন্সিপাল রুমে গিয়ে শোভনের আর কয়েকজনের নামে কমপ্লেন করে এলো।শোভন আর তাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজনকে ডেকে প্রিন্সিপাল বেশ করে ধমকানি দিলেন।


সেদিন রাতে ফার্স্ট ইয়ারের আর কোনো ছেলেকেই ওপরে

যেতে হলোনা।এই ভাবে আরও দুটো দিন কেটে গেলো।প্রীতম তার রুমমেটদের বোঝালো যে একবার কমপ্লেন করতে ওরা ভয় পেয়েছে।কিন্তু প্রীতমের কথা যে ভুল তা প্রমাণ হলো পরের রাতে।সবকটা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেকে তিন তলার রুমে ডাকা হলো।তারা রুমে গিয়ে দেখে রুমেতে গাঁজার গন্ধ মো মো করছে।সিনিয়রদের একজন প্রীতমকে ডেকে বললো-


-যা তুই হোস্টেলের বাইরে গিয়ে আমার জন্য মদ নিয়ে আয়।


-আমি পারবোনা দাদা।


-পারবিনা মানে...যা মদ নিয়ে আয়।নয়তো..


-পারবোনা আমি।


দ্বিতীয়বার যখন পারবোনা কথাটা ধ্রুবর কানে এলো সে

বিছানায় শুয়ে ছিলো আচমকা উঠে এসে প্রীতমের কানের

নীচে ফটফট করে দু চড় লাগিয়ে দিয়ে-


-তুই আমাদের ছেলেদের নামে কমপ্লেন করেছিস প্রিন্সিপালের কাছে।এত সাহস তোর।তুই জানিস আমি কে।


প্রীতম যেন বিশ্বাসই করতে পারলোনা ধ্রুব দা।যাকে সে সিনিয়রদের মধ্যে ভালো ভাবতো সে ওদের প্রধান।তার নির্দেশেই জুনিয়রদের ওপর এসব করা হয়।ধ্রুব শোভনকে

নির্দেশ দিলো-


-আবৃতি না কি নাম মেয়েটার।ওর শরীরের বিবরণ এর মুখে ফোনে রেকর্ড কর।আজ রাতেই এটা সবার ফোনে পাঠিয়ে

দিবি।তারপর কাল দেখছি ও কীকরে কলেজে যায়।


শোভন ধ্রুবর কথা মত প্রীতমের ওপর চড়াও হয়ে তাকে বাধ্য করালো ফোনের রেকোর্ডারে আবৃতির চেহারার বিবরণ বলতে বাধ্য করাতে।সে যতবার না করেছিলো তত বার তার চেহারায় লেগেছিলো গভীর আঘাতের দাগ।সব শেষে যখন তাদের তিন তলার ওই ভয়াবহ রূম থেকে ছাড়া হলো তখন প্রীতম মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে একেবারে।গতকাল সে কীভাবে মুখ দেখাবে সারা কলেজের সামনে।তাকে যে জোর করে সিনিয়াররা...আর ভাবতে পারলোনা সে।একরাশ মানসিক যন্ত্রনা সে সহ্য করতে না পেরে তিন তলার বিল্ডিং থেকে নিজেকে ছুঁড়ে দিলো এক অজানা ধূসরতায়।র‍্যাগিং এর মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রনা সহ্য

করতে না পেরে এভাবেই নিভে গেলো এক জলজ্যান্ত তরুন 

প্রান।


বলা হয় যে,র‍্যাগিং এর মধ্যে দিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা

হয় কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে।কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসী করে তোলার পন্থাটা এমন কেন হবে যে একজনের জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে একদিন।একটা সন্তানের মৃত্যু কেবল তার জীবনটাই কেড়ে নেয় না সাথে নিয়ে যায় তার মা তার বাবা তার ফ্যামিলির জীবনটাও।তাদের ঘরের প্রদীপটা আজীবন এর জন্য নিভিয়ে যায়।শিক্ষা সবসময় আলোর পথ দেখায়।যে শিক্ষা আলোর পথ দেখানোর নামে চরম অন্ধকারের দিশায় ঠেলে দেয়।আদৌ তা কী সুশিক্ষা?সমাজে তার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে?প্রশ্নটা আপনাদের জন্য রাখা রইলো কিন্তু....।


(সব চরিত্র কাল্পনিক)

-শুভঙ্কর সাউ


এমন বাস্তব জীবনের গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post