স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অবহেলার গল্প | অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা

 আমার স্ত্রী ইদানীং তার তিহাত্তর কেজি ওজন নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেছে। বিয়ের সময়কার একটা ব্লাউজও গায়ে আঁটছে না,বোরকা পরলে চেপেচুপে শরীরে এঁটে থাকে, সালোয়ার-কামিজ পরলে পেট উঁচু হয়ে থাকে। তার এতসব পরিবর্তনে যদিও আমার কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। বরঞ্চ শরীরে ওজন গেইন করায় গায়ের রঙ আগের চেয়ে আরো  টুকটুকে ফর্সা  হয়েছে।হাসলে গালে গোলাপি আভা ওকে আরো প্রানবন্ত লাগে। ওর তুলতুলে পেটে হাত রেখে ঘুমানো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হল,

-নারী জাতি পুরুষের মুখে সত্যি কথা কোনোদিন বিশ্বাস করে না।

একশটা সত্যি কথা বলার পর তাদের একটা মিথ্যা বলবেন অবললীয়ায় বিশ্বাস করে নিবে।আমার স্ত্রী নীলিও ব্যতিক্রম নয়। তার আজকাল ধারণা হয়েছে,


 আমি তাকে আর ভালোবাসি না,পছন্দ করি না।

তার দিকে তাকানোর ইচ্ছা পর্যন্ত হয় না।


কাহিনীর শুরুটা বলা যাক,গত শুক্রবার আমার চাচাতো বোনের বিয়ের রিসিপশনের দাওয়াত ছিল। স্ত্রী,আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে হাজির হলাম। নীলি সেজেগুজে তার পছন্দের বেনারসি কাতান পরে রেডি হয়ে গেল। বিয়ে উপলক্ষ্যে সাড়ে আট হাজার টাকায় এই শাড়িটা কিনেছে। নীল ওর পছন্দের রঙ।


সবাই ওর শাড়ির খুব পছন্দ করল।কত দাম, কোথা থেকে কিনেছে প্রশ্নের জবাবে ও হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছিল। আমার ছোট খালার মেয়ে নীরা ফ্যাশন সচেতন। বলল,


-শাড়িটা খুব সুন্দর ভাবী কিন্তু মোটা মানুষদের হালকা রঙ পরলে স্লিম দেখায়।


অন্য একজন মন্তব্য করল,


-আরে কাতান পরলে এমনিতেই মোটা দেখায়। আর তোমার তো স্বাস্থ্য মাশা-আল্লাহ।


এই কথাগুলো নীলি সহজভাবেই নিচ্ছিল বাঁধ সাধল 

বাড়িতে এসে।নীলি বলল,


-ইশ! আমার শাড়ির সাথে ঝুমকো কানের দুল পরলেই ভালো লাগত। এটা একদম খেত লেগেছে দেখতে।


-কোনটা?


-তুমি দেখো নাই আমি কোন কানের দুল পরেছি?


-খেয়াল করি নাই।


-আচ্ছা।

ততক্ষণে মিসেসের মুখ শক্ত হয়ে গেছে। ঘটনা যে এতদূর গড়াবে বুঝতে পারি নাই নয়ত তখনই কান মলে মাফ চেয়ে নিতাম।


রাতে ঘুমাতে গেছি ওর পেটে হাত রাখতেই বলল,


-সরো।গরম লাগছে।


হাত সরিয়ে নিলাম। সত্যি খুব গরম পরেছে। সারাদিন বিয়েবাড়িতে খুব খাটুনি গেছে ঘুমিয়েই পরেছিলাম।ঘুম ভাঙল রাত একটার দিকে। কানের কাছে মশা যেমন 

প্যানপ্যান শব্দ করে তেমনি প্যানপ্যান শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম মশা আবার পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। প্যানপ্যানানির ভলিউম আরো বাড়লে বুঝতে পারলাম মশা না আমার বউ। সে তার বিখ্যাত কান্না শুরু করেছে। একটা মানুষ কত বেশি সময় ধরে কান্না করতে পারে তার প্রতিযোগিতা হলে আমার বউ নীলি গিনেজ বুকে নাম উঠাতে পারত। যতক্ষণ না ওকে স্পর্শ করব ননস্টপ কান্না করে যেতে পারে।


ঘুমচোখে উঠে ওর হাত ধরলাম,

-কি হয়েছে?


কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না।তারমধ্যে যতটা বুঝতে পারলাম, মোটা হবার কারণে ওরদিকে আমি আর নজর দেই না। অবসর সময় আগে ওর সাথে গল্প করতাম এখন টিকটক মেয়েদের নাচাগানা দেখি৷ শুধু আমি  সবাই ওকে মোটা বলে। স্কুলে ছেলের বন্ধুর মায়েরা বলে, মোটা ভাবী। বাজার করতে গেলে লোকে হাসাহাসি করে। ইত্যাদি। ইত্যাদি। 


নীলিকে কেউ মোটা বললে আমার কষ্ট হয়। বিয়ের পর যখন সবাই বলত, বউ শ্যামলা তখনও কষ্ট হত। নীলি আমার ভালোবাসার মানুষ। এই মানুষটার কপালের ব্রণ,হাঁটুর পোঁড়া দাগ, তলপেটে সিজারিয়ানের দাগ নিয়ে আমি ভালোবেসে যাই। ভালোবাসার জন্যে একটা অবয়ম দরকার৷ সেই অবয়ব কালো না ফর্সা,বেটে না লম্বা তা দেখার প্রয়োজন হয় না। নীলি আমাকে ভুল বুঝছে। যতই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,ভালোবাসি তবু ওর কান্নার প্রকোপ বাড়ে। প্রায় দেড়ঘণ্টা ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না করবার পর সিদ্ধান্ত নিল ও ডায়েট শুরু করবে। এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি আমার নীলিকে খুব ভালো করে চিনি৷ একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সহজে পিছপা হয় না।বললাম,


-আচ্ছা।তোমার যা ভালো লাগে করো। এখন ঘুমাও। সকালে ছেলেদের পরীক্ষা। 


সকাল না হতেই এবাড়িতে যুদ্ধ শুরু হয়।সেনাপতি নীলি   পানির ঝাপ্টা, ফ্যানের সুইচ অফ করে দুই ছেলেকে অতিকষ্টে ঘুম থেকে উঠায়। রুটি বেলে,চা করে, সবজি-ডিম খাবার টেবিলে দুটোই থাকর  আবার টিফিনক্যারিয়ারে স্বামী-সন্তানদের জন্যে  খাবার গুছিয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে রেডি হয়। ছেলেদের নিয়ে স্কুলে যেতে হবে যে! বারোটা অবধি ছোটটার ক্লাস। বড়টার দুইটা। দুপুরে মাছ,ডাল, ভাজি কোনোদিন শাকের সাথে মাংস। জানি না দেড় ঘণ্টার মধ্যে নীলি এতসব রান্না করে আবার কিভাবে দুইটায় বড়টাকে স্কুল থেকে আনতে ছোটে। দুজনকে খাইয়ে,গোসল করিয়ে কোচিংএ পাঠিয়ে বিকালবেলা নীলির এক চিমটি অবসর। ওইসময়টুকু ও ঘুমায়। হাত-পা ছড়িয়ে স্কুলে পড়ুয়া মেয়েদের মত নাক ডেকে ঘুমায়। ছুটির দিনে আমরা বাপ-বেটা যখন চার্লি চ্যাপলিন দেখি।নীলির তখনও ঘুমানো চাই না। আমি বিরক্ত করি না।সন্তপর্ণে কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমু খেয়ে। আহা ক্লান্ত মেয়েটা!


ডায়েট শুরু করবার পর নীলি বিকালে আর ঘুমায় না। রোজ অফিস থেকে ফিরে দেখি ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে নীলি সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করছে। নিজের জন্যে গ্রীন টি বানাচ্ছে। দুপুরে সুপের বাটিতে এক বাটি ভাত খাচ্ছে। প্রথমে তো কিটো ডায়েটই শুরু করেছিল বহু কষ্টে নিবারণ করিয়েছি। এত পরিশ্রম করা একজন মানুষের দুপুরে ওইটুকু ভাত খেলে পেট ভরে! আমরা বাঙালি সবজির সাথে ভাত নয়, ভাতের সাথে সবজি খেতে অভ্যস্ত। বাচ্চাদের সন্ধ্যায় পিৎজা,বার্গার, সমুচার আবদার থাকে। অফিস থেকে ফেরার সময় একটু বেশিই কেনা হয়৷ ছেলেদের মত ছেলের মাও যে ফাস্টফুুড খেতে ভালোবাসে। এখন বাড়ি ফিরি খালি হাতে। হোক ও দুই ছেলের মা। আমার চেয়ে নয় বছরের ছোট নীলি এখনও কিশোরী মেয়েটিই যে রয়ে গেছে। বাচ্চারা খাবে, ওর খেতে ইচ্ছা করবে খাবে না।ভাবতে কষ্ট হয়।


রাতে বাচ্চাদের পড়াশোনা করিয়ে,খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়াতে ১১ টা বেজে যায়। বাচ্চারা ঘুমায় আমি আর নীলি খেতে বসি। আমার প্লেটে মাংস,ডাল, সবজি।নীলি ছোট একটা রুটি আর এক চামচ সবজি খায়।  সবজি তো আর মুখেই রুচে না।চোখ বন্ধ করে গিলে খায়। ওর প্লেটের দিকে তাকালে মাংস-ভাতও আমার মুখে রুচে না


বিশ্বাস করুন,সেই মুহূর্তে সেইসব মানুষগুলোর প্রতি তীব্র ঘৃনা জন্মে যারা বাজারে,পথে-ঘাটে, নামকাওয়াস্তে আত্মীয়-স্বজন আমার স্ত্রীকে মোটা বলে,হাতি বলে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ শুধুমাত্র হাভাতের মত খেলেই মোটা হয় না,হরমোনাল সমস্যা থাকলেই মোটা হয় না। কিছু মানুষ জন্মগতভাবে ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। তাদের হাওয়া খেলেও ওজন বাড়ে।নীলি বিয়ের সময়ও সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল। দুটো বাচ্চা হয়েছে। ওজন বেড়েছে। সিজারের পর পেট বেড়েছে।সারাদিন গাধার মত খাটুনি করে দুটো ভাত বেশি খায় তাতে যদি ওজন বাড়ে তাতে কার কি এসে যায়!বাঙালি মেয়েরা স্বামী-সন্তানকে সর্বস্ব দান করে নিজের চুল আঁচড়ানোর সময়টুকু পায় না। ভালো-মন্দ খাবে তাও সমাজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে,


-তুমি মেয়ে মানুষ।বেশি খেও না। ওজন বেড়ে যাবে।


যা বলছিলাম, নীলি ডায়েট করছে পনের দিন চলছে। ওজন কমেছে কি না জানি না কিন্তু চোখের নীচে কালসিটে পরে গেছে। ওইটুকু খেয়ে প্রায় অভুক্ত পেটে ঘুমাতে যায়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাতে ভালো ঘুম আসে না। আবার সকাল না হতেই রেলগাড়ি তো ছুটছেই।

যতবার ওকে বোঝাতে চাই, ওজন কমানোর দরকার নাই। সুস্থ আছ আলহামদুলিল্লাহ, চেষ্টা করো আর যেন না বাড়ে ততবারই রেগে যায়।আমি নাকি ওর ভালো চাই না।


কালকে নীলির জন্মদিন। ওর পছন্দের রেড ভেলভেট কেক নিয়ে বাসায় ঢুকলাম।বারোটার পর হৈচৈ করে বাচ্চাদের কেক কাটব। বাড়ি ফিরে দেখি,বাসা নিস্তব্ধ। দুষ্ট দুটোর মুখ শুকনো। মা মাথা ঘুরে মেঝেতে পরে গেছে। সোফার কোণা লেগে মাথা ফেটেছে এই এতখানি। নীলি শুয়ে আছে। দুই ছেলে অপরাধীর ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়ানো।বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম,

-তোমরা যাও। আমি তোমাদের মায়ের পাশে আছি।

নীলি চোখ মেলল,

-কি জানি হল! চোখে অন্ধকার দেখলাম আর মাথা ঘুরে পরে গেলাম। 

তোমার এই ডায়েট-ফায়েট রাখো। চেহারার কি অবস্থা হইছে আয়নায় দেখেছ?

-ওজন কত জানো?

-কত?

-তিহাত্তর কেজি পাঁচশ গ্রাম। আরো মোটা হয়ে গেছি।

পরম যত্নে নীলির মাথায় হাত রাখলাম,

-নীলি, এই পৃথিবীতে লক্ষকোটি সুন্দরী নারী কিন্তু তুমি একমাত্র নারী যে আমার একান্ত ব্যক্তিগত। আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে। ভালো থাকার জন্যে এই কি যথেষ্ট নয়?


নীলি চোখ বন্ধ করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।


-কাল থেকে আমার জন্যে রাত ১১ টা পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকবে না। আটটার মধ্যে পেট ভরে খেয়ে নিবে। কেমন? আর বাড়িতে ফাস্টফুড আনা হবে সপ্তাহে একদিন। তোমার আর ছেলেদের ফলমূল খাবার অভ্যাস করতে হবে।ঠিক আছে?


-ঠিক আছে।


নীলির ৩৫ তম জন্মদিন পালিত হচ্ছে।ঘরভর্তি আলো নেই। মোমবাতি জ্বালানো হয় নাই। ছেলেদেরও ঘুম থেকে তুলি নাই।নীলি বিছানায় বসে ওর পছন্দের রেড ভেলভেট কেক একটু একটু করে খাচ্ছে আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।


ঠিক বারো বছর আগের মত সেই আমি এখনও ওর হাসির প্রেমে পরে যাই।


গল্পঃনীলির কথা বলছিলাম

হাবিবা


মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post