মানুষ বড়ই স্বার্থপর
কাছে আসবে না! কেমন বিশ্রী পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ আসছে তোমার গা থেকে। একটা বুয়া বিয়ে করেছি আমি... বুয়া.......!
চরম বিরক্তির সাথে কথাটা বলেই পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করল আবিদ ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অস্ফুটে দিবা । ইদানিং আবিদকে যে কোন কথা বললেই বিরক্ত হয় সে। এক বিছানায় ঘুমালেও কেমন যেন দূর দূর করে দিবাকে।
ওদের পাঁচ মাসের মেয়ে আমিরা ঘুমাচ্ছিল খাটের একপাশে। দিবা ওকে মাঝখানে শুইয়ে দিতেই ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে উঠল সে ।
-উফফ্ একটু শান্তিতে ঘুমানোর উপায়ও নেই , জানে যে সকালে উঠলেই অফিসে ছুটতে হবে আমাকে। সারাটাদিন বাসায় বসে কি যে করে আল্লাহ্ই জানেন, বাচ্চাটাকে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে স্বামীর জন্য কোথায় একটু পরিপাটি হয়ে বিছানায় আসবে তা না , পারে শুধু ঢলঢলে ত্যানা ত্যানা ম্যাক্সিটা পরে ভূতের মত ঘুরে বেড়াতে ।
গজগজ করে ফুসতে ফুসতে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় এসে শুয়ে পরল আবিদ।
খুব সুন্দর মিষ্টি একটা মুখ দেখল আবিদ , আরও একটু কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো , হ্যা রিয়া। কি দারুণ করে হাসে রিয়া । হাসলেই গোলাপী গালে টোল পরে তার ।
কি হলো ভুমিকম্প না কি ?
- এ্যাই ওঠো এখানে অনেক মশা শোবে চলো ।
দিবা ডাকছিল আবিদকে। মেয়েকে খাইয়ে , ডায়াপার বদলিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে আবিদকে ডাকতে এসেছে সে।
নাহ্ রিয়াকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্নটা আজও শেষ পর্যন্ত দেখতে পারল না আবিদ। অফিসে আবিদের কলিগ রিয়ার পাশ দিয়ে যতবার গেছে আবিদ , এক মাতাল করা সুগন্ধি যেন এসে লাগে তার নাকে ! মেয়েটা দেখতেও যেমন পুতুলের মত , তার হাসি , কথা বলার স্টাইলও ঠিক তেমনই আকর্ষণীয় । অফিসে সব পুরুষগুলো ওত্ পেতে থাকে , রিয়ার একটু হাসি একটু চোখের চাহুনির ত্রিসীমানায় আসতে পারলেই যেন জীবনটা ধন্য হয়ে যায় সবার।
অথচ বাড়ি ফিরলেই সেই বোরিং দিবা । সদ্য মা হওয়া বেঢপ শরীরটার দিকে তাকাতেও এখন আর রুচি হয় না আবিদের ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আবিদ -দিবা যখন চুটিয়ে প্রেম করত তখন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি ফিনফিনে পাতলা গড়ণের ভিষণ পরিপাটি পোশাকের দিবা একদিন এভাবে বদলে যাবে।
কি একটা অপরাধ বোধ দিনের পর দিন যেন কুড়ে কুড়ে খায় দিবাকে। সে জানে স্বামীর মন জয় করাটা কঠিন কিছুই নয় কিন্তু সারাদিন এত কাজের চাপে হাপিয়ে যায় দিবা। শ্বশুরশাশুড়ি গ্রামে থাকেন । নিজের মা অসুস্থ থাকেন বছরের বেশিরভাগ সময়। ছোট্ট দুইরুমের একটা বাসা নিয়েছে আবিদ । কাজে সাহায্যকারীনিকে দুই কাজের বেশি কাজ দেবার মত সামর্থ্যও নেই তাদের।
দিবার স্কুল জীবনের বান্ধবী রিনা ফোন করেছে :
- কালকে আমাদের এসএসসি গ্রুপের রিইউনিয়ন। তোকে
কিন্তু অবশ্যই যেতে হবে দিবা। কোনভাবেই মিস করা যাবে না। কোন বাহানাও শুনব না, বুঝেছিস ?
- কি করব বল? আমার বাচ্চাটা খুবই ছোট আর তোর
ভাইয়াও রাজি হবে না যেতে ।
- উহু আমি তোর কোন কথাই শুনব না। তুই এখনই বাসার ঠিকানা আমাকে পাঠায় দে ।
পরদিন রিনা এসে প্রায় একরকম জোর করেই নিয়ে গেল দিবাকে। ওখানে যাবার পর সবাই অনেক আদোর করল দিবার ছোট্ট মেয়েটাকে। সেই স্কুল জীবনের প্রিয় মুখগুলোর সাথে দেখা হলো, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে কথা হলো । পুরোনো রঙীন দিনগুলো যেন ভেসে উঠতে লাগল চোখের ওপর । ওর সব বান্ধবীরাই জামাইসহ উপস্থিত অথচ আবিদ কখনও যেতে রাজি হয় না। দিবার আরেক বান্ধবীও গেছে পাঁচ-ছয় মাসের বাচ্চাসহ। ওখানে প্রোগ্রামের পুরোটা সময় বাচ্চা তার বাবার কোলে । পিলো পাসিং খেলার সময় জাহানারা ম্যাডাম দিবার বাচ্চাকে এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলেন। উনি ছিলেন বাংলার শিক্ষিকা , বললেন
-যাও, আনন্দ করো,রোজ রোজ তো আর এমন সুযোগ পাবে না !
স্কুল জিবনে দিবার বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।পড়ালেখায়,খেলাধুলায় আর কালচারাল প্রোগ্রামে বরাবরই ভালো ছিল দিবা। এখনও আবিদ ছাড়া সবার কাছেই কদর আছে তার। লটারি হলো, লটারিতে দ্বিতীয় পুরস্কার দশ হাজার টাকা পেল দিবা। খুব খুশি সে আজ।
রিনাকে বাসায় আসতে বলল সে যেকোন একদিন সময় করে। কি না কি জরুরি কথা আছে তার।
রিনা যেদিন এলো সব কিছু খুলে বলল দিবা তাকে। রিনা বলল দিবাকে ,
-তুই আবার আগের মত হয়ে যা। স্বামীকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা বাদ দে। যার কাছে তোর কদর নেই তাকে এত তোলা তোলা করে মাথায় তুলেছিস বলেই আজ তোর এই অবস্থা। তাকে বুঝতে দিতে হবে তোর অভাবটা , তোর প্রয়োজনটা। তোকে স্বার্থপর হতে হবে নিজের ভালোর জন্য। নিজেকে শক্ত করার জন্য।
বাসায় এসে দিবা ভাবতে লাগল, একটা সময় অনুভব করতে পারল কি ভিষন বদলে গেছে সে। এখন আর সে নিজের যত্ন নেয় না , নিজেকে সে মানুষ বলেই মনে করে না সেখানে আবিদকে আর কি দোষ দেবে সে।
দিবা ঠিক করল আজ থেকে সে আবার আগের মত হয়ে যাবে । নিজেকে ভালোবাসবে , নিজেকে প্রাধান্য দেবে সবচেয়ে বেশি ।
সকালে আবিদের ঘুম ভাঙল, মেয়ে আমিরার কান্নায়। বাচ্চা তারস্বরে চিৎকার করে কান্না করছে অথচ পাশে দিবা নেই এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা এর আগে কখনই দেখেনি আবিদ। বাচ্চাকে কোলে তুলে শান্ত করতে করতেই দিবাকে খুঁজতে লাগল সে। না পেয়ে ফোন দিল। দুইবার রিং হবার পর তৃতীয় বারে রিসিভ করল দিবা।
- হ্যা, কি হয়েছে আবিদ?
-কি হয়েছে মানে? বাচ্চাকে ফেলে রেখে কোথায় গিয়েছ তুমি ?
- আমি একটু হাঁটতে বেরিয়েছি । তুমিই তো বল সারাদিন শুয়ে বসে থেকে মুটিয়ে গেছি আমি আর বাচ্চাটা কি শুধুই আমার একার ? তোমার কোন দায়দায়িত্ব নেই?
- হয়েছে এত জ্ঞান দিও না। ঢাকা শহরে একজনের আয়ে সংসার চালানো খুবই মুশকিল আর এই আসল কাজটাই করি আমি।
- আবিদ , তোমার মনে হয় স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। সমস্যা নেই আমি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি , আমার রেজাল্ট তোমার চেয়ে বরাবরই বেশি ভালো ছিল আর আমার অনেক ভালো ভালো চাকরির অফারও ছিল। বিয়ের পর আমি শুধু ঘর সামলাব এই ডিসিশনটা কিন্তু তোমার ছিল।
-এইসব বকবকানি বন্ধ করে এখন বল আমিরা কি খাবে?
-সাইড টেবিলে ফিডিং বটল রাখা আছে বলেই খটাশ করে কেটে দিল ফোনটা দিবা ।
দিবা বাসায় ফিরে এলো ঘন্টা খানিক পর।
দরজায় বেল দিতেই আদিব বাচ্চাকে দিবার কোলে দিয়ে
- ধরো তোমার মেয়েকে , বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল
অফিসের উদ্দেশ্যে । সারাটা দিন দিবা ঘরের কোন কাজ করল না আজ। আবিদ চলে যাবার পরই সেও বেরিয়ে গেল বাচ্চাকে নিয়ে । রিনা এসে নিয়ে গেল তাকে। রিনার সাথে একটা জায়গায় গেল সে। যেখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিভাবে একজন সাধারণ নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন । লটারিতে পাওয়া টাকাটার কথা জানায়নি আবিদকে সে। ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করবে না দিবা। নিজের স্বপ্নগুলোকে একটু একটু করে বাস্তবায়ন ঘটাবে সে। মেয়ে আমিরা তার প্রেরণা। কয়েকজন বান্ধবী মিলে শুরু হবে তাদের নতুন দিনের পথ চলা। পথের এখন অনেক বাকি তবে শুরুটা যখন সাহস করে করতে পেরেছে শেষটা নিয়ে ভয় কেটে গেছে তার।
আবিদের জন্য এখন কষ্ট হয় তার বেচারা সন্ধ্যায় এসে রান্না করে। সার্বক্ষণিক সকাল সন্ধ্যায় কাজ করার জন্য একজন সাহায্যকারীনি রেখেছে দিবা। ছয়মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করে কাপড়ের ব্যবসায়ের একজন সফল নারী উদ্যোক্তা এখন দিবা। অফিস কলিগ রিয়ার দিকে ঘুরে তাকানোর সাহস আর নেই আবিদের। রিয়ার পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করে করে অবশেষে বুঝতে পারল সে, রিয়ার দৌড় আরও উপর মহলে শেষে চাকরি নিয়ে টানাটানি দেয়ালে পিঠ ঠেকে , প্রাণটা বেরিয়ে যায় যায় দশা ।
একদিন আবিদ অফিস থেকে ফিরে মাফ চাইল দিবার কাছে। আবিদ যে তার অফিস কামাই করে ঘুরতে যেত রিয়ার সাথে রেস্টুরেন্টে খেত এসবই কানে আসে দিবার, চাউর হয় অফিস মহলেও।
দিবা একটা শর্ত দিলো আবিদকে ,
- রাতের রান্না আর সন্ধ্যার পর থেকে বাচ্চার দেখাশোনা করবে তুমি। তারপর আমি বরং ভেবে দেখব তোমার মত মানুষকে ক্ষমা করা যায় কি না।
লজ্জায় যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন আবিদের। তখনই প্রথমবারের মত খেয়াল করল আবিদ দিবাকে। যত্ন নিতে নিতে নিজেকে রুপসী করে তুলেছে দিবা। নাহ্ আর কখনও কষ্ট দেবে না দিবা কে সে।
-স্বার্থপর।
লেখা : রেজওয়ানা_ফেরদৌস।