মায়ের ভালোবাসার স্ট্যাটাস
ছোট দুই সন্তানের ভাষায় আমি বড় ছেলেকে মানুষ করতে পারি নাই। বেশি আদরে হয়েছে জড়বস্তুর ন্যায় অপদার্থ। গামলা ভর্তি ভাত খাওয়া আর কুম্ভকর্ণের মত ঘুমানো ছাড়া ও আর কিছুই শিখে নাই। এটা সত্যি জুয়েল খেতে ভালোবাসে। সামান্য ডাল ভর্তা প্লেটে তুলে দিলে শুকনা মরিচ চটকে আরাম করে ভাত খায়। পাশেরজন পোলাওকোরমা খেলেও ফিরেও তাকাবে না আমার বড় ছেলেটাই এতটাই সরল। শুধু সরল নয় কাণ্ডজ্ঞানহীনও বটে। প্রথম রোযার দিন ও শাহীনের দুই ছেলের জন্যে জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসল৷ চীনা হাওয়াই হাফহাতা শার্ট। বুকের কাছে সমুদ্রসৈকতের ছবি আঁকা। বাচ্চারা উপহার পেলে খুশি হয়,দুই নাতি হলুদ-কমলা শার্ট গায়ে আনন্দ লাফাতে লাগল। স্বভাবতই শাহীন এবং তার স্ত্রী ব্যাপারটা পছন্দ করল না। শাহীন আমার ছোট ছেলে, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সহকারী নির্বাহী কর্মকতা। অফিসের ঝা চকচকে কালো গাড়ি দিয়ে চলাফেরা করে। বাচ্চাদের নামীদামী ব্রান্ডের পোশাক অনলাইনে অর্ডার করে। শীপে এসে পৌঁছায়।
শাহীন বড় ভাইয়ের সামনে কিছুই বলল না। আমার ঘরে এসে প্যানপ্যান করতে লাগল,
-দাদার কি কোনোদিন আক্কেল হবে না? এসব ক্যাটক্যাটে রঙ আমরা ওদের পরাই? একদমই সফ্ট না গরমে এলার্জি উঠে যাবে।
বৌমা আমার আরো এক ডিগ্রি উপরে।সে মুখে কিছু বলবে না। চুপিসারে ননদিনীকে ফোন করে বিস্তারিত জানাবে। ছোট কন্যা থাকে জার্মানী। দুই বছরের মেয়েকে সামলে বাইরে কাজ করার সময় পায় না কিন্তু দুই ভাইয়ের সংসারে কখন কি ঘটল তাতে নাক গলানোর ঠিকই সুযোগ পায়। ছোট ভাইয়ের শিক্ষা আছে, ক্লাস আছে তাই দহরমমহরম ছোট ভাবীর সাথেই বেশি। বড় ভাবী একসময় মায়ের মত আদর করতেন, চুল টেনে কাছে বসিয়ে উকুন মেরে শক্ত করে বেনুনি গেঁথে দিতেন সবকিছু ভুলে গেছে। বড় দাদার প্লেটের ডিমের কুসুম,মাছের মাথা লুকিয়ে লুকিয়ে বোনকে খাওয়ানো হত সেসব আজ অতীত।
সংসার ভাগ হলে রক্তের ধারাও ভাগ হয়ে যায়।
ছোট দাদার টাকা আছে তাই বোনের প্রতি ভালোবাসাও আছে।অন্তত শেফা তাই মনে করে।
তা যা বলছিলাম, জুয়েল সোফায় বসে পা দুলাচ্ছে। অনেকক্ষণ বসে আছে। ছোট ভাই আর তার বউ একবার খোঁজ নেবার জন্যেও দ্বিতীয়বার বসার ঘরে প্রবেশ করে নাই তাতে ওর মাথাব্যথা নাই। দুই ভাইয়ের ব্যাটা নতুন জামা পড়ে সোফার উপর লাফাচ্ছে ও আনন্দিত চোখে তাকিয়ে আছে।আমায় দেখে বলল,
-আম্মা, দেখছনি তোমার নাতিগো কারবার! শাহিনও ছোটকালে নতুন জামা পাইলে এমন করত। তাই না আম্মা?
-জুঁইদের জন্যে থ্রিপিস কিনেছিস?
-না আম্মা, মাইয়ামানুষের জামাকাপড় আমি চিনি না। ওগো মায় কিনে দিব শেষ রোযার দিকে।তুমি বাড়ি যাইবা?
এইটুকু বলে ও মাথানীচু করে রইল।
প্রতিবার ঢাকা এলে একটাই আব্দার।
-আম্মা,বাড়ি চলো।
আমার হাইপ্রেসার,ডায়বেটিসের উছিলা ধরে আর যাওয়া হয় না। প্রতি মাসে প্রায় সাত হাজার টাকার ওষুধ লাগে শাহিনের বাড়ি থাকলে ঔষুধের চিন্তা থেকে মুক্তি।সাত হাজার টাকা বড় ছেলের পরিবারের একমাসের বাজার খরচ। তবু যেতে ইচ্ছা হয়। একফালি উঠান, চৌচালা টিনের ঘর,দূরে কলঘরের পাশে পুঁইশাকের মাচা আমার স্বামীর ভিটে।পয়ত্রিশ বছরের আবাসস্থল হাতছানি দিয়ে ডাকে। ওর বাবার ছোট মুদি দোকান ছিল। বাবার মৃত্যুর পর বাঁধা খরিদ্দার জুয়েলের দোকানেই আসে, কলা-পাউরুটি খায়, চাল-ডাল কেনে। বিশ বছরে উন্নতি বলতে বাবার দোকান বেশ বড় করেছে,বাড়ির মুলির বেড়ার ঘর ভেঙে চৌচালা ঘর তুলেছে। শাহিন, শোভা উপরের সোপান টপকে সাই সাই করে উপরে উঠে গেছে তার তুলনায় জুয়েল কিছুই করতে পারে নাই। যা কিছুটা আয়ব্যয় ছিল মহামারীতে তাও বিপর্যস্ত। বড় বউ ফোন দিয়ে অভিযোগ করে,
-আম্মা,আপনের পোলার জীবনে জ্ঞানবুদ্ধি হইব না? লকডাউনের মধ্যে মাইনষেরে ধারকর্জ দিয়া দোকান সাফ করে ফেলল। কয়,লোকজনের হাতে টাকা নাই।যখন টাকা হইব তখন দিব এদিকে পাইকারের কাছ থেকে মাল কেনার পয়সা নাই। দুই মাইয়ারে নিয়া আমার পথে বসতে হইব।
জুয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম,
-জুঁইএর মা কেমন আছে?
--ভালোই আছে তয় সারাদিন চিল্লাচিল্লি করে। ছিটগ্রস্থ মহিলা।
-তুই যে ওদের জন্য জামাকাপড় কিনে ঢাকা চলে এসেছিস জুঁইএর মা জানে?
-আল্লাহ! মা কইতে যাইও না ওরে।শুনলে বেটি জাতি সাপের ফোঁসফোঁস শুরু করব আমার লগে।
-বউকে না জানিয়ে এসব আনতে গেলি কেন?
এবার ছেলে হাসে।
-কিযে বলো মা। শাহিন, শোভা ওরা ছোট ভাইবোন হইয়াও আমার দুই মাইয়ারে কতকিছু দেয়। আমারো তো দিতে ইচ্ছা হয়, টাকা-পয়সা নাই বিঁধায়...
জুয়েল কথা শেষ করতে পারল না শাহীন এসে দাঁড়িয়েছে। বড় ভাই হয়েও জুয়েল ছোট ভাইকে খানিকটা ভয় পায়। শাহিনের কেতাদুরস্ত শার্টপ্যান্টের সামনে আধময়লা সাদা লুঙ্গি, পাঞ্জাবিতর জড়োসড়ো হয়ে থাকে। জুয়েল বলল,
-আজ উঠি।তোর বউরে নিয়ে ঈদের মধ্যে গ্রামে আসিস। জৈষ্ঠ্যমাসে গাছে আম পাকা শুরু করব, পোলাপান খুশি হইব।
-দেখি। তোমাদের ওদিকে তো খুব ঝড়বৃষ্টি হয়। মিলা ভয় পায়।
-ও।
জুয়েল চলে গেল। যাবার আগে একবার করুন চোখে আমার দিকে তাকাল। ভাইয়ের সামনে অনুনয় করতে সাহস হল না। চোখের ভাষায় বলল,
-আম্মা বাড়ি চল। মেয়ে দুইটা অনেক খুশি হইব।
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।তারপর বেলকুনি থেকে দেখছিলাম। জুয়েল হেলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যবয়স্ক লোক মায়ের চোখে ছেলেটাই রয়ে গেল।
শাহিন আমার যত্নের কমতি করে না। বউমা পথ্য,ওষুধ ঠিকই গুছিয়ে রাখে।এই যেমন ইফতারে ফ্রুট কার্স্টাডে আমার জন্যে চিনি দেয় না,শরবতে সুগার ফ্রী।ইফতারে ছোলামুড়ি খাবার চল নাই। নিত্যনতুন আইটেম বানায়, এতসবের নাম কি আর আমি জানি। নাতি দু'জন আমার অজ্ঞতা দেখে খিলখিল করে হাসে,
- দাদু এটা নাম দইবড়া। তুমি কিচ্ছু জানো না।
ওদের বাবামা দাদির সাথে ছেলেদের খুনসুটি খুব উপভোগ করে। আমার বুকের ভেতরটা খালি খচখচ করে। জুঁইএর মায়ের সাথে রোজ কথা হয়,
-আজকে কি রান্না করছ?
-লইট্টা শুঁটকি।
পরদিনের মেনু হয়।
-আম ডালের সাথে ডিম ভুনা।
-তোমাদের রোযার বাজার করে নাই?
-একবারে বেশি মাছ কিনে রাখব কই আম্মা। ফ্রীজ নষ্ট।
রোযার আগে ফ্রীজ ঠিক করবার দরকার ছিল। জুঁই,যুথী দুইবোন মায়ের মতই পরহেজগার, কোরআন খতম নিয়েছে। সারাদিন রোযা রাখার পর ডালভাত খায়। জুয়েল বাড়িতে বাজার না করে ভাইয়ের বেটাদের জন্য ঈদের জামা নিয়ে এসেছে। শাহিনের পছন্দের পুকুরের কই মাছ, নদীর বোয়াল।
অকৃত্রিম ভালোবাসাময় উপহার। শোভা ওর ছোট ভাবীর জন্যে অনলাইন থেকে অর্ডার করেছে চমৎকার জামদানি শাড়ি। দাম শুনলাম ১৭ হাজার টাকা! ভাইয়ের বেটাদের জন্যে ব্রান্ডের পোশাক আসছে। ছোট বউও বিদেশে ননদিনীর জন্যে দামী, লেহেঙ্গা,থ্রিপিস কুরিয়ারযোগে পাঠিয়ে দিয়েছে। গ্রামের বাড়িতেও উপহার যায়। অবহেলায় অনাদরে পাঁচ দশ হাজার টাকা৷ বড় ভাইকে না দিলে খারাপ দেখায় তারজন্যে দেওয়া। ওদের কি একবারও ইচ্ছা হয় না যুথী, জুঁই পরীর মত মেয়েদুটোর জন্য একটা জামা কিনতে? হয় না।
২১ রোযার দিন জুঁইএর মা ফোন করে কান্নায় ভেঙে পরল,
-আম্মা,আপনার ছেলেকে বোঝান।
-কি করেছে?
- আমার গহনা নিয়ে সুদে টাকা এনে দোকানে মাল তুলেছে। মুরগির ডিম বেঁচে, বাজার খরচ থেকে পয়সা বাঁচিয়ে মেয়েদের জন্যে গয়না গড়েছি। আম্মা ঘরে সোমত্ত মেয়ে। ওদের বিয়ে দেব কিভাবে!
-আমি জুয়েলের সাথে কথা বলব।
ভাইবোন যে ওকে অপদার্থ বলে মন্দ বলে না। মেয়েদের পেটে খাবার নাই,পোশাক নাই বাপ দোকানে মাল তুলছে। শাহীন, জুয়েল দুজন ছাত্র হিসেবে সমমানের ছিল। কিন্তু শাহীন পরিশ্রমী। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক স্কুল কামাই করত না। পরীক্ষার আগের রাতগুলো হারিকেন জ্বালিয়ে সারারাত পড়ত।জুয়েল বন্ধুদের নিয়ে হইহট্টগোল আর ঘুমিয়েই উঠতি বয়স পাড় করে ফেলেছে। এখন কোনোক্রমে সংসার চলে, বাড়িতে টিনের চালা উঠেছে সমস্ত জুঁইএর মায়ের কল্যাণে। এইট পাস, শ্যামবর্ণের ছোটখাট গড়নের সালমা খাতুনকে জুয়েলের বাবা পুত্রবধূ
পছন্দ করতেন না অথচ এই সালমা খাতুনই গত তেইশ বছর ধরে গ্রামের বাস্তুভিটা টিকিয়ে রেখেছে।
প্রতি বছর ২৬ শে রমজান এবাড়িতে যাকাতের টাকা বিলানো হয়। শাহীন কিছু টাকা এতিম খানায় দেয়, কিছু টাকা দাতব্য চিকিৎসালয়ে আর বাকি অংশ আমার হাতে দিয়ে বলে,
-আম্মা আমাদের গ্রামের বাড়িতে যারা দুস্থ,অসহায় আছেন তাদের বিতরণ করো। প্রতিবেশী হিসেবে তাদেরও একটা হক আছে।
ছেলের এই আচরণে যারপরনাই খুশি হই৷ মন থেকে দোয়া আসে। শাহীন চাইলে নিজ হাতেই দান করতে পারত কিন্তু মায়ের হাতে দিয়ে মাকে বড় রাখে।শোভাও কিছু টাকা ব্যাংক ড্রাফট করে পাঠায়।
-আম্মা,গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের দিয়েন।
ঈদ করতে বাড়ি গেলে আমি আর জুঁইএর মা লিস্ট করতে বসি।জুঁইএর মা গ্রামে থাকে বিধায় কার হাড়িতে ভাত নাই, কার গেল বছর স্বামী মারা গেছে সমস্ত খবরাখবর জানা।বড় বউকে নিয়ে গ্রাম দেখতে বের হই। তিনশ, পাঁচশ টাকা কারো একবেলার হাতখরচ কেউ এই টাকা হাতে পেলে প্রাণভরে দোয়া করে। আমি বলি,
-মা, আমার তিনসন্তানের জন্যে দোয়া কইরেন।
একথা শুনে জুঁইএর মায়ের চেহারা চুপসে যায়। মনে পরে নিজের পরিবারেরই অভাবঅনটন পরকে সাহায্য করবে কোথা থেকে।
এবার মহামারীতে গ্রামে যাওয়া হবে না। শাহীন টাকা দিয়ে বলল,
-আম্মা, বড় ভাবীকে বিকাশ করে দিয়েন। তিনি আপনার ইচ্ছামত বিলিব্যবস্থা করে দিবেন।
বহুদিন লকডাউনে ঘর ছেড়ে বের হই না। ছোট বউ শপিং, বাজার অনলাইনে সারে। তবু আজ বিকাশ করার উছিলায় বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে বড়বউকে ফোন দিল,
-সালমা তোমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছ?
-জ্বী আম্মা। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিস্তি তুলছিলাম তখন অ্যাকাউন্ট খুলছিলাম।কেন যাকাতের টাকা পাঠাবেন?
-হ মা। কিন্তু এবার টাকাটা তুমিই রাখো।
-আপনি এসব কি বলছেন,মা? আপনার ছেলে জানতে পারলে আমাকে খুন করে ফেলবে।
-ওই বলদকে কিছু বলতে হইব না। তুমি টাকা দিয়া গহনার ঋণ শোধ করো ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় বউ হুহু করে কেঁদে উঠল।
- রোযার মধ্যে একদিনও মেয়েদুইটার পাতে মাছভাত দিতে পারি নাই। লজ্জায় বলতে পারি নাই শাহীন যেই টাকা দেয় তার থেকে আমাদেরও কিছু দিয়েন।
কান্না সংক্রামক। কথা বলতে গিয়ে দেখি আমার গলাটাও ভারী হয়ে উঠছে।চোখের পানি মুছে বললাম,
-শোনা, মা। ধৈর্য্য ধরো।আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের উত্তম প্রতিদান দিবেন।
ততক্ষণে আমার বড়বউও শক্ত হয়ে উঠেছে।
-হ্যা মা। টাকাটা আমি ধার হিসেবে নিলাম। একদিন যাদের টাকা তাদের ঘরে ঠিকই পৌঁছে দিব।
-ইনশাআল্লাহ। জুঁইকে নীল রঙের থ্রিপিস কিনে দিও।গেল বছর রোযার ঈদে ওর ছোট কাকীর নীল রঙা ওড়না নেড়েচেড়ে অনেকক্ষণ দেখছিল।
-আম্মা, আপনি সব মনে রেখেছেন।
হাসতে হাসতে জবাব দিলাম,
-মায়েদের সব মনে রাখতে হয়।
————————————————————★
❣️❣️ সমাপ্ত ❣️❣️
————————————————————★
গল্পঃঅসুখী
হাবিবা সরকার হিলা