রহস্যময়ী নারী | রহস্যময়ী | রহস্যময় গোয়েন্দা গল্প

 রহস্যময় গল্প | রহস্যময় | রহস্যময় মানুষ | রহস্যময় ঘটনা

রহস্যময় গল্প | রহস্যময় | রহস্যময় মানুষ | রহস্যময় ঘটনা

বিয়ের পর রিশাদ অদ্ভুতরকম পাল্টে গেছে। আর দশজন বিবাহিত পুরুষের মতো পাল্টে যাওয়া নয়। এ যেন এক অন্যরকম পাল্টে যাওয়া। স্মার্ট, সুদর্শন ছেলেটাকে দেখে মনে হলো যেন বয়স এক ধাক্কায় দশ বছর বেড়ে  গেছে। কথাবার্তাও কেমন অসংলগ্ন। সবাই বলে যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে তার মধ্যে কোনো একটা ঘাপলা আছে। মেয়েটা কেমন একটু অদ্ভুত রোবট টাইপ। কথা বলে খুব কম। চালচলনেও একটু অন্যরকম। কিন্তু কেউ পরিস্কার করে বলেনা যে অন্যরকম ব্যাপার টা ঠিক কেমন।  


বড়লোক বাপ মায়ের ছেলেমেয়েরা নাকি কিছুটা উচ্ছন্নে যাওয়া হয়ে থাকে। জীবনে যা কিছু দরকার সব হাতের কাছে পেয়ে যায় বলেই হয়তো বেশী উচ্ছন্নে যায়। তবে রিশাদ কে তেমন বলা যায় না। পড়াশোনা, স্পোর্টস, ক্যারিয়ার সবকিছুতেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। আর এসবের সঙ্গে বাপের টাকা কে পুঁজি করে একটার পর একটা মেয়ের সর্বনাশ করে গেছে। রিশাদের নেশা ছিলো মেয়েমানুষ। ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেম এবং শেষ পর্যন্ত  বিছানায় গিয়ে প্রেমের ইতি ঘটতো। এরকম কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে তার হিসাব মনে হয় ও নিজেও ঠিকঠাক জানে না। ওর পরিবারও ছেলের এই জঘন্য কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতো। কিন্তু নিজেদের ছেলের দোষ আড়াল করে প্রশ্রয় দিতো শাসনের বদলে। 


বন্ধুমহলে রিশাদ খুব গর্বের সঙ্গে মেয়েঘটিত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতো। কেউ কেউ খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতো, আবার কেউ কেউ ওকে বর্জন করা শুরু করলো। কথায় আছে দূর্জন বিদ্যান হলেও পরিতাজ্য। ঠিক সেকারনে রিশাদ কে আমি বর্জন করেছিলাম। কর্পোরেট চাকরির অজুহাতে আড্ডা, রিইউনিয়নেও যাওয়া বন্ধ করলাম। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত থাকার কারনে জানতে পারলাম রিশাদ বিয়ে করছে। তাও আবার ফ্যামিলির পছন্দ করা এক মেয়েকে। শুনে বেশ অবাক হলাম। একটু কৌতুহল হলো। যে ছেলের কাছে একটা মেয়েকে বেশীদিন ভালো লাগে না, সে ফ্যামিলির পছন্দসই বিয়ে করছে! ব্যাপার টা একটু গোলমেলে লাগলো। রিশাদ কে ফোন করে জানতে চাইলাম হঠাৎ এমন ডিসিশন নেয়ার কারণ কী। সত্যিই সব ছেড়েছুড়ে পুরোদস্তুর সংসারী হচ্ছে। 


আমার কথা শুনে রিশাদ হো হো করে কিছুক্ষণ গলা ফাটিয়ে হেসে বলল, আরে না। এতো বছরের অভ্যাস কী সহজে ছাড়া যায়? বিবাহিত পুরুষের তকমা টা লাগাচ্ছি। তাছাড়া জেনারেশন বাড়ানোর একটা ব্যাপার স্যাপার আছে তো নাকি! 


বুঝে গেলাম যে একটা সহজ, সরল মেয়েকে বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। যাকে লোকের চোখে স্ত্রী আর উত্তম পুরুষ বাড়ানোর জন্য বৈধতা দেয়া হচ্ছে। অচেনা, অজানা মেয়েটার জন্য খানিক টা দুঃখ হলো।  


*

ভেবেছিলাম রিশাদের বিয়েতে যাওয়াটা বর্জন করব। কিন্তু বন্ধুদের জোরাজুরিতে যেতে হলো।  রিশাদকে সবসময়ের মতো বিন্দাস দেখা গেল। কিন্তু চমকে উঠলাম মেয়েটাকে দেখে। এতো সুন্দর মেয়ে! কবি সাহিত্যেকদের ভাষায় যাকে বলে আগুন সুন্দরী। মহাভারতের ধ্রুপদী'র 

সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কল্পনায় সোজা সরল একটা মুখ ভাবলেও তা ছিলো না। চোখের চাহনী কেমন যেন অন্যরকম। বেশীক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না। আমার মনে হলো, হয়তো আমার চোখেই এমন লাগছে তাই এ ব্যাপারে কারোর সঙ্গে আর আলাপ করলাম না।  কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে কানে এলো যে রিশাদের বউয়ের চোখে নাকি বিষ দৃষ্টি। তাকানোর ভঙ্গি মারাত্মক রকম ভয়ানক। অবশ্য রিশাদের সঙ্গে দেখা হয় নি তাই ওর মনোভাব জানাও হয় নি। কিন্তু আজ যখন বিপর্যস্ত রিশাদের সাথে দেখা হলো তখন মনে হলো সত্যিই একটা কিছু গন্ডগোল আছে। 


বিয়ের পর এই প্রথম দেখা। শুকনো মুখাবয়ব, চোখের নীচে বিশ্রী রকম কালি, উসকো খুশকো চুলের রিশাদ কে দেখে আমি বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, 


"তোকে এমন লাগছে কেন?" 


আমার সাদামাটা প্রশ্নের জবাব দিতে রিশাদ অনেক সময় নিলো। উদভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল, 


"একটা কিছু ঝামেলা আছে বুঝলি..


"কিসের ঝামেলা? " 


রিশাদ ইতস্তত করলো প্রথমে। তারপর বলল, তোকে বলব। কিন্তু তুই অন্যদের বলিস না প্লিজ। সবাই হাসির খোড়াক বানাবে আমাকে নিয়ে।


এই রিশাদ আমার পরিচিত নয়। এতোটা বিচলিত আজ অবধি কখনো দেখিনি। মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারিতেও রিশাদ কখনো বিচলিত ছিলো না। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো, টাকা ছড়ালে এভ্রিথিং ইজ ওকে ব্রো। 


রিশাদ গলা খাদে নামিয়ে বলল, তুই জ্বীন, ভুতে বিশ্বাস করিস?" 


আমি বিস্মিত গলায় বললাম, কী বলছিস? 


"ওই যে লোকে বলে না, জ্বীনের আছড় না যেন কী?" 


"আমি এসব লোকমুখেই শুনেছি। সত্যতা জানি না।" 


এবার আমার কাছে ব্যাপার টা কিছুটা পরিস্কার হলো। রিশাদ কী তবে ওর বউয়ের ব্যাপারে এসব ভাবছে? আমার মনে পরে যায় বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই চোখ দুটোর কথা। আমি রিশাদ কে জিজ্ঞেস করলাম, 


"তোর বউয়ের কী এমন কোনো সমস্যা আছে, যার জন্য তুই এসব ভাবছিস?" 


রিশাদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কান্নার মধ্যে বলতে লাগলো, আমার জীবন টা ওলট, পালট হয়ে গেছে। একদম শেষ হয়ে গেছে। 


***

রিশাদের ভাষ্যমতে ওর বউ স্বাভাবিক মানুষ নয়। বিয়ের রাতে প্রথম সেটা টের পেয়েছে। অন্তরঙ্গ মুহুর্তে প্রথম টের পেল শরীর থেকে  বিশ্রী রকমের পোড়া গন্ধ আসছে। এরপর থেকে আতঙ্কিত রিশাদ বউয়ের দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভয় পায়। কয়েকদিনের মধ্যে আরেকটা রহস্য উদঘাটন করে। মেয়েটা নাকি অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পায়। বাড়ির লোক সেই ভয়ে তটস্থ থাকে। 


***

আমি রিশাদের ব্যাপার টা মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারছিলাম না। ছেলেটা সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এরপর কানে এলো যে ওদের বাড়ি অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে। রিশাদের এক আত্মীয়া ওর মায়ের কাছে বউয়ের নিন্দে করছিল। দেখা গেল তার মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটার হাতের পাঁচ আঙুল মটমট করে ভেঙেছে। এসব কোনো কিছুই স্বাভাবিক নয় সেটা সবাই বুঝে গেল। পাড়ার লোক, আত্মীয়দের সঙ্গে রিশাদ দের বাড়ির দূরত্ব বেড়ে গেল। কেউ নাকি ও বাড়িতে যাওয়া তো দূরে থাক, বাড়ির দিকে তাকায় ও না। 


কয়েকমাস পর শুনলাম রিশাদ চাকরি বাকরি সব ছেড়ে দিয়েছে। কেন,  কী কারন সেসব কেউ জানে না। কারোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই, বাড়ি থেকে বের ও হয় না। ভয়ে সম্ভবত কেউ কৌতুহলও দেখায় না। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। জগতে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের যেমন আগ্রহ বেশী থাকে তেমন হলো। মেয়েটার সঙ্গে আবারও আলাপ করার ইচ্ছে হলো। 


অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। রিশাদ দের বাড়িতে শেষ পর্যন্ত গেলাম। বাড়িতে পা রেখেই অন্যরকম অনুভূতি হলো। গা ছমছমে অনুভূতি। বাড়ির লোকজনগুলোও কেমন যেন হয়ে গেছে। সবার আচরনেই পরিবর্তন। রিশাদের বাবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। কথা বলতে পারেন না। ভদ্রলোক অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকেন। তবে সে চোখ যতটা অসহায়, তার চেয়ে বেশী ভয়ের। রিশাদের মা'ও ভয়ে তটস্থ। সবচেয়ে বেশী অবাক হলাম রিশাদ কে দেখে। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বউ যা বলছে, যন্ত্রের মতো সেসব করছে। কথাবার্তার সুযোগ হলো না। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো।  আমাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়াও হলো না। 


কাজের মেয়েটাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। রিশাদের মাকেও প্রশ্ন করে কিছু জানা গেল না। কেউ একটা টু শব্দটি পর্যন্ত করে নি। যেন সবার উপর কড়া হুকুম আছে যেন কথা না বলে। 


রিশাদের বউয়ের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। মেয়েটা কাজের মেয়েকে দিয়ে নাস্তা না পাঠিয়ে নিজেই নিয়ে এসেছিল। তখন ফিসফিস করে বলল, এতো কৌতুহল ভালো না। 


কন্ঠস্বর শুনেই ভয়ে হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কোনোভাবেই সাহস সঞ্চার করে আমি মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। অতিদ্রুত আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েও স্বাভাবিক হতে পারলাম না। মনে হলো মেয়েটা আমার গতিবিধি এখনো পর্যবেক্ষণ করছে।


***

সেদিনের সেই ঘটনা নিজের মধ্যে চেপে রাখলাম। কাজে ডুবে থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি ঠিকই তবুও কিছু প্রশ্ন মনে বারবার উঁকি দিয়ে যায়। রিশাদের কথা আমার সত্যি মনে হলো। ওর মিথ্যে বলে লাভ  ই বা কী! যদি তাই ই হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো মেয়েটার রহস্য কী? আসলেই কী জ্বীনের আছড় টাইপ কিছু!  


এই প্রশ্নগুলোর আগে জানা দরকার মেয়েটা আসলে কে! রিশাদ দের বাড়িতে যা ঘটছে সব কিছুর পিছনে যে ও আছে সেটুকু বুঝেছি৷ বাড়ির প্রত্যেকটা লোককে হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। দারোয়ান থেকে শুরু করে বাকী সবাইকে। কিন্তু কেন করছে এসব! 


মেয়েটার নাম, ঠিকানা খুঁজে পেতে তেমন সমস্যা হলো না। মেয়েটার নাম মালোবিকা। আগে নাম টা শুনলেও কাটখোট্টা নাম বলে স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। মালোবিকার বাবা, মা নেই। এক্সিডেন্টে মারা গেছে। কোন এক আত্মীয়ের কাছে থাকতো। মফস্বল শহরের দিকে বাবা, মা'কে নিয়ে থাকতো। কৌতূহল দমনে শেষমেস মালোবিকার আগের এলাকায় গেলাম। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজ করতেই পাওয়া গেল। তবে সেখানে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আর ওটাই আমার জীবনে ভয়াবহ চমক ছিলো৷ 


বছর পাঁচেক আগে পত্রিকায় একটা খবর বেরিয়েছিল যে এক বাড়িতে অগ্নিদগ্ধে স্বামী, স্ত্রী মারা গেলেও অক্ষত অবস্থায় একটা মেয়ে ফিরে এসেছিল। আগুনের মধ্যে থাকলেও পুড়ে যায় নি। সেই সময়ে মেয়েটাকে নিয়ে পত্র, পত্রিকায় অনেক লেখাও হয়েছিল। সেই মেয়েটাই মালোবিকা। পুরো বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও মালোবিকা একদম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। অনেকেই ভাবে অলৌকিক ক্ষমতা বলে ফিরে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি অলৌকিক ক্ষমতা থাকতো ই তাহলে বাবা, মাকে কেন বাঁচালো না? 


রিশাদের সঙ্গেই বা শত্রুতা কিসের? 


রিশাদ কী মালোবিকার এই সত্যিটা জেনে বিয়ে করেছিল? নাকি ওই সময়ের পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়নি বলে বুঝতে পারে নি। 


মালোবিকার ওই আত্মীয়দের খোঁজেও গিয়েছিলাম কিন্তু তাদের পাওয়া যায় নি। তারা কোথায় আছে আশেপাশের কেউ সেটা বলতে পারে না। 


আমার মনে নানান রকম প্রশ্ন আসলেও রিশাদ দের বাড়ি যাবার দুঃসাহস আর করিনি। কিন্তু প্রশ্নগুলো বারবার তাড়া করে বেড়ায়। 


মালোবিকার সঙ্গে কী রিশাদের দ্বন্দ নাকি ওর বাবা মা'র? 


মানলাম অলৌকিক ক্ষমতা আছে৷ কিন্তু রিশাদ কে কেন নরকযন্ত্রনা দিচ্ছে? তবে কী রিশাদের কোনো অতীত বা পূর্ব কর্ম জড়িত? 


মালোবিকার কোনো বোন নেই। পরিচিত কারোর সঙ্গে রিশাদের সম্পর্ক ছিলো যেটার শোধ নিচ্ছে! 


ওর আসল উদ্দেশ্য টা ঠিক কী? রিশাদ কে একটু একটু করে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মারা? 


কেন যেন মনে হলো পুরো ঘটনা রিশাদ কে ঘিরে। মালোবিকা রিশাদ কে শাস্তি দিতে চায়৷ হয় রিশাদের দোষে বাবা, মা বাকীরা কষ্ট পাচ্ছে। নাহলে বাপ, মায়ের কোনো কর্মফল ছেলেকে ভুগতে হচ্ছে। 


আর রিশাদের বলা কথাগুলোর সত্যতা কতটুকু?  সত্যিই কী অলৌকিক ক্ষমতা আছে!  নাকি পুরোটাই মাইন্ড গেম! 


-অনুগল্প : শোধ


মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post