স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অবহেলা | অবহেলার কষ্টের গল্প

অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

অবহেলার কষ্টের স্ট্যাটাস

 নতুন বাসায় উঠার পর থেকেই একটা জিনিস বারবার চোখে পড়ছে,আমাদের বারান্দার মুখোমুখি পাশের বিল্ডিং এর একদম লাগোয়া বারান্দায় একজন মাঝবয়সি মহিলা,বয়স সর্বোচ্চ ৪০ হবে,তিনি প্রায়ই মন খারাপ করে বারান্দার  গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন,দিনে বা রাতের বেশীর ভাগ সময়টাতেই উনি বারান্দায়ই কাটান।


আমি যতোবার ই বারান্দায় যাই কাপড় চোপড় নাড়তে ততোবার ই চোখে পড়ে। কখোনো কখোনো রাতে ঘুম ভাঙলে টয়েলেটে যাওয়ার সময় বারান্দা থেকে চাপা কান্নার স্বর শুনতে পাই। আবিরকে বিষয়টা নিয়ে দুএকবার বলেছি,সে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি।


একদিন না পারতে আমি ঐ মহিলার সাথে যেচে পড়ে কথা বললাম,আমি জানতে চাই উনার কি এমন দুঃখ,কি এমন কষ্ট যে জীবনবটা একটা বারান্দায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো।

কথায় কথায় জানতে পারলাম উনি একজন ক্যান্সার রোগী,ডাক্তার সময় বেধে দিয়েছে বড়োজোর ৭/৮ মাস বাচঁবে,এখন উনাকে দেখা শোনার জন্য উনার ছোটবোন এসে রয়েছে,সংসার সামলাচ্ছে,হাজবেন্ড ব্যাংকে চাকরি করেন,আর একমাত্র ছেলে কলেজে পড়ে,হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে,বাসায় উনারা তিনজন ই বলতে গেলে।


কথা গুলো শুনার পর ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেলো,মানুষের জীবনে কতরকম কষ্ট থাকে ভাবা যায়!আমি উনাকে আপা বলেই ডাকা শুরু করলাম,এরপর থেকে আপার সাথে আমার প্রতিদিন টুকটাক কথা হতো,আমি যতটুকু পারতাম আপাকে সঙ্গ দিতাম,অল্প দিনের পরিচয়ে আপা কেমন আপন হয়ে গেলো আমার।


.


একদিন দুপুর বেলা আপার ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেঙে গেলো,দৌঁড়ে বারান্দায় গেলাম,আপাকে খুব উষ্কখুষ্ক লাগছে,মলিন গলায় বললো,


- 'মিরা তোমার বাসায় চিংড়ি  মাছ আছে আমার খুব চিংড়ি ভুনা খেতে মন চাচ্ছে, আমার জন্য নিয়ে আসবে?'


আমার মনটা ভিষন খারাপ হয়ে গেলো,এই প্রথম আপা মুখ ফুটে কিছু একটা খেতে চাইলো,কত সময় কত কিছু সেধেছি,নিতে চায়নাই,এখন যাও চাইলো কিন্তু বাসায় তো চিংড়ি নেই,আমি বললাম,


- 'আপা চিংড়ি নেই,আমি ছোট আলু দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল আর টমেটোর টক রান্না করেছি খাবেন?'


আপা খুশিতে আপ্লুত হয়ে বললো,

- 'অবশ্যই খাবো,আমার খুব খুদা পেয়েছে,বাসায় তো কেউ নেই,আমার বোনকে টুকটাক কেনা কাটা করে দিতে আমার হাজবেন্ড শপিং এ নিয়ে গেছে,আর যা রান্না করা আছে তা মুখে দেওয়া যাচ্ছে না,রুচিতে কুলোয়না এখন সব খাবার।তাই তোমাকে বলা,কিছু মনে করোনা বোন।'


আমি তরিঘরি করে টিফিন ক্যারিয়ার এ করে খাবার নিয়ে প্রথমবারের মতো আপার বাসায় গেলাম। আপা আমাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে বসালো।


আপার রুমে ঢুকে আমি ধাক্কা মতো খেলাম,ছোট সিংগেল একটা খাট,খুব এলোমেলো স্টোর রুমের মতো একটা রুম,এটার সাথে বারান্দাটা,পাশের রুমটা পরিপাটি গুছানো,কাপল রুম বোঝাই যাচ্ছে,হিসেব অনুযায়ী ওটা আপার রুম হওয়ার কথা।


আমার মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তবু চুপ করে রইলাম। আপা খুব তৃপ্তি নিয়ে সবটুকু খাবার খেলো,খাওয়া শেষে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, 


- 'কতদিন পর পেট ভরে খেলাম জানিনা,আল্লাহ তোমাকে সুখি করুক'


আপা তার ছেলের ছবি দেখালো, কতশত গল্প আওড়ালো, আমি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলাম, হয়তো অনেকদিন পর মন খুলে কথা বলছে,তবে আমার মনের কনফিউশন আর ধরে রাখতে না পেরে বললাম,


- 'আপা পাশের রুমটায় কে কে থাকে? আপনি এখানে একা থাকেন?'


আপা মুহুর্তেই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলো,অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে বললো,


- 'বোন ডেকেছো লুকাবো কি আর বলো? আসোলে ঐটা আমার সতীনের সংসার,সে আমার বোন নয়!সংসারটা আমার ছিলো, এইতো গত বছর ও ঐ রুমটাই আমি আর শফিক থাকতাম আর এটায় আমার ছেলে থাকতো।সাজানো গোছানো ছিমছাম সংসার।'


আমি কিছু বলার আগেই আপা আমার দুইহাত মুঠোতে নিয়ে বললো,


- 'মিরা আমার জীবনে অনেক দুঃখ,তোমার কি দুদন্ড সময় হবে কথা গুলো শোনার? খুব হাসফাস লাগে জানো কাউকে বলতে পারিনা।আল্লাহ ছাড়া কাউকে পাইনা বলার,কিন্তু আল্লাহ তো নিশ্চুপ থাকে,আমাকে শান্তনা দেয়না,শান্তনা কই পাবো বলোতো?'

বলেই আপা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।


আমি আপার নিষ্প্রাণ চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম,গলা দিয়ে আমার কোনো কথা বেরুচ্ছে না। আপা নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,


- 'জানো মিরা আমার যখন প্রথম ক্যান্সার ধরা পড়ে তখন ডাক্তার বলেছিলো, ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করালে আমি সুস্থ হয়ে যেতে পারি,অনেক টাকা লাগবে। সেদিন বাসায় আসার পর তুহিনের আব্বু যখন হাউমাউ করে কান্না করছিলো।আমি তাকে শান্তনা দিয়ে বলেছিলাম, ‘কেঁদোনা,আমি সুস্থ  হয়ে যাবো, গ্রামের বাড়ির উত্তরের জমিটা বেঁচে দেও, চিকিৎসার টাকা জোগাড় হয়ে যাবে।’ তখন সে মাথা নেড়ে 'হ্যা' সূচক সম্মতি জানালেও,কিছুদিন পর যখন আবার বললাম, ‘কি ব্যবস্থা করছো জানাও না তো কিছু!’


তখন ই তুহিনের আব্বু আমতা আমতা করে বললে, ‘আমাদের তুহিনের ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতে হবে,একটা মাত্র জমি বেঁচে দেওয়া কি ঠিক হবে?আর তা ছাড়া তুমি সুস্থ হবে এটার শিউরিটি তো ডাক্তার দিচ্ছে না,যদি শিউর হতাম তবে না হয় বেচেই দিতাম।’


আমি খুব অবাক হয়ে তুহিনের আব্বুর মুখটা দেখলাম।হুট করে খেয়াল করলাম ঐ চেহারায় কোনো মায়া নেই, ভালোবাসা নেই, কিচ্ছু নেই। আমি তাহোলে এতোদিন মরিচিকার পেছনে ছুটেছি। মানুষ কত নিষ্ঠুর হয়, ১৯ বছর সংসার করার পর তার মনে হলে আমার মৃত্যু মেনে নেওয়াটা খুব সহজ!


সেদিন থেকে আমার মৃত্যু ভয় শুরু হলো, কেননা আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার বেঁচে থাকার চেয়ে জমি থাকাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আমি নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে শুরু করলাম। তখন আমার ছেলেটা আমার কাছেই থাকতো,এরপর ওর বাবা তরিঘরি করে ওকে হোস্টেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো।বললো, ‘আমার অসুস্থতা দেখে নাকি ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি হবে।’ সেদিন না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম কেনো ছেলেকে হোস্টেল এ পাঠিয়েছে। যখন দেখলাম আমি বেঁচে থাকতেই নতুন কাউকে আমার সংসার হস্তান্তর করা হয়েছে।


বুঝলে মিরা আমার স্বামী আমাকে বুঝ দিয়েছে, ‘আমাকে দেখাশোনা করার জন্য নাকি লোক লাগবে, তাই বিয়ে করে এনেছে যেনো সমাজ আবার খারাপ কথা না বলতে পারে।’

 কিন্তু আমার খোঁজ নিতে কেউ তো এ ঘরে উঁকিও দেয় না। আমি শরীরের যন্তনায় যখন চিৎকার করি তারা বিরক্ত হয়ে দরজা বন্ধ  করে দেয়।


আমি রাতেও বারান্দায় বসে থাকি, এ ঘর থেকে পাশের ঘরের সুখের আওয়াজ শুনতে আমার ভিষন কষ্ট হয়, আমার শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট খুব বেশী হয়।তাদের সুখের সংসার,প্রেম ভালোবাসা এগুলো আমি সহ্য কেনো করতে পারছিনা বলোতো?


জানো একদিন রাতে আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী আবদার করলো, নতুন বড় ফ্ল্যাট কিনে দিতে। আমার প্রানপ্রিয় স্বামী তাকে আশ্বস্ত করে বললো, ‘এখন ফ্ল্যাট কিনলে সবার চোখে সে খারাপ হয়ে যাবে যে চিকিৎসা কেনো করালো না।’ সে শান্তনার স্বরে বললো, ‘আর তো কয়েকটা মাস এরপর তোমার মনের মতো করে সব গুছিয়ে দিবো, চিন্তা করোনা।’


সেদিন সারারাত আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি।কার জন্য সংসার সাজালাম, কাকে উজার করে ভালোবাসলাম, সে কিনা আমার মৃত্যুর প্রহর গুনে? আমি কখোনো কিচ্ছু  চাইনি ওর কাছ থেকে ভালোবাসা ছাড়া,আর সেটাও পেলাম না। আ'ত্মহত্যা মহাপাপ না হলে কবে নিজেকে শেষ করে ফেলতাম।'


কথা গুলো বলতে বলতে আপা জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো।


আপার সাথে সাথে আমার চোখ থেকেও পানি ঝরছে। আবিরের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।


আমি আপাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললাম,

- 'আপা আল্লাহ আপনার ধৈর্যের ফল নিশ্চয়ই দিবেন, আপনি পরপারে সুখি হবেন।'


কেনো জানিনা বাসায় ফিরে আমি হাউমাউ করে কাঁদলাম। আমার আপার জন্য ভয়ানক কষ্ট হতে লাগলো। কত নির্মম কষ্ট আল্লাহ কারো কারো জন্য নির্ধারন করে রেখেছে ভাবতেই শিউরে উঠছি। একটা মানুষ মৃত্যুর আগে না পাচ্ছে চিকিৎসা না পাচ্ছে স্বামীর ভালোবাসা, সন্তানটাও দূরে।


.


রাতে আবিরের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, 


- 'পুরুষ মানুষ শুধু শারীরিক সুখ খুঁজে তাইনা আবির?মনের কোনো দাম নেই ওদের কাছে।'


আবির ভারী গলায় বললো,

- 'সবাইকে এক পাল্লায় মেপোনা, তুমি যখন অসুস্থ হও আমি সারারাত জেগে তোমার সেবা করতে করতে কখনো ক্লান্ত বোধ করিনা। যখন তুমি সুস্থ হও তখন খুব শান্তি অনুভব হয় যে আমি সেবা করে তোমাকে সুস্থ করতে পেরেছি। সেবা করায়,যত্ন করায় ও যে সুখ আছে এটা খুব কম মানুষ ই উপলব্ধি করতে পারে। আমি ভাগ্যবান এদের মাঝে আমিও আছি।'


আমি আবিরকে জরিয়ে রেখে বললাম,

- 'আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।'


.


এর মাঝে আমার শাশুড়ী অসুস্থ হওয়ায় আমাকে গ্রামে যেতে হলো। যাওয়ার সময় আপাকে কথা দিয়েছিলাম, ফিরে এসে আপাকে চিংড়ি ভুনা খাওয়াবো।কিন্তু ফিরে এসে দেখি আপা তো নাই, শুন্য বারান্দায় হাহাকার।। আমার ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আপার তো আটমাস বাঁচার কথা ছিলো, এখোনো ২ মাস বাকি।


আমি ছুটে গেলাম ও বাড়িতে। খোঁজ নিয়ে জানলাম আপা মারা গেছেন, তবে ক্যান্সারে নয়,হার্ট এ্যাটাক করে। আপাকে খালি বাসায় ২ দিনের রান্না করে দিয়ে নাকি তারা স্বামী স্ত্রী শশুড় বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনদিন পর এসে আপাকে মৃত দেখতে পান। পুরো একদিন আপার লাশ রুমে পড়ে থেকে পঁচন ধরেছিলো। তাই পুলিশ কেস হয়। পোস্ট মার্টোম এ জানা যায়, ‘আপা ভয় এবং মানসিক চাপ থেকে হার্টস্ট্রোক করে মারা যান!’


আপা ভেবেছিলো ক্যান্সারে মরবেন কিন্তু আপা তো রোগে মরেনি। আপাকে খু'ন করা হয়েছে, কতটা অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে আপা দুনিয়া ছেড়েছে। পুরো অন্ধকার বাসায় আপা মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করেছে, পাশে বসে মাথায় হাত বুলানোর কেউ ছিলো না, দোয়া পড়ার কেউ ছিলো না, শুন্য বাসায় আপা একবুক অভিমান নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছে।


আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, আপাকে দেওয়া কথা তো রাখতে পারলাম না। আপাকে আর চিংড়ি ভুনা খাওয়ানো হলো না। এই আফসোস নিয়ে আমাকে সারাটা জীবন কাটাতে হবে।


.


আপার মৃত্যুর পর আমি কয়েকমাস মানসিক সমস্যায় ভুগেছি। মাঝরাতে উঠে আবিরকে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে বলতাম, ‘আমাকে ছেড়ে যেওনা, আমাকে একা রেখোনা!'


আবির এর যত্নে আস্তে আস্তে ট্রমা কাটিয়ে উঠলেও এখনো মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আপাকে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, আপার চুল গুলো এলোমেলো, চোখের নিচে কালশিটে দাগ, আপা উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি চিৎকার করে আপাকে ডাকি, ‘আপা আপনাকে ছাড়া আমি চিংড়ি খাবো না, কখনো না!’


কিন্তু আপা তো আমার ডাক শুনতে পায়না…….


(সমাপ্ত)...


সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে

ছোটগল্প || সূর্যগ্রহন

লেখা || উম্মে_শারমিন_নিহা


এমন আরও গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post