স্বামীর সংসার | সংসার ভাঙ্গার কারণ | সংসার সন্ধি বিচ্ছেদ

সংসারে অশান্তি

সংসারে অশান্তি

 আমার স্ত্রী অনেকটা বুদ্ধি করেই আমার সাথে আমার মায়ের মধ্যে একটি সম্পর্কের ফাটল সৃষ্টি করে আমাকে মায়ের থেকে আলাদা করেছে। প্রথম দিকে আমি আমার মা'কে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারি পুরোটাই আমার স্ত্রীর একটি চাল। আমার স্ত্রী রাইসা কিন্তু এতোটাও বুদ্ধিমতী মেয়ে নয় যে সে আমাকে এতোটা সহজেই মায়ের কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে। তাহলে ওর এই চালবাজির পিছনে কে কলকাঠি নেড়েছিল? 

বিষয়টা আমি বুঝতে পারি মায়ের সংসার থেকে আলাদা হওয়ার একবছর পর। 

প্রতিদিনই অফিসের কর্মব্যস্ততা কাঁটিয়ে যখন ঘরে ফিরি তখন ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতেই আমার প্রতি রাইসার যত্নআত্তি পুরোদমে ফুটে ওঠে। বিয়ের পর থেকেই ওর এরকম কেয়ারনেস দেখে ভেবেছিলাম আমি সত্যিই এক ভাগ্যবান পুরুষ। কিন্তু এই কেয়ারনেস নামক মায়াজালের ফাঁদে ফেলেই যে ও আমার বাবা মা এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় সেটা বুঝতে আমার অনেকটা সময় পেড়িয়ে গিয়েছিল। 


সেদিন যখন চালাকি করে রাইসার অজান্তেই ওর মোবাইলের কল রেকর্ডটি অন করে দেই তখন ভিতরের কথাগুলো শুনে মুহূর্তেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। কারণ আমার পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কচ্ছেদের মূল কারিগর ছিলেন স্বয়ং আমার শাশুড়ি নিজেই। সেদিনের কল রেকর্ডের কথাগুলো শুনে বুঝতে পারি আমার শাশুড়ি আমার স্ত্রীকে বুঝাচ্ছেন কিভাবে নিজের স্বামীকে নিজের মায়াজালে আটকে ফেলে পরিবার থেকে দূরে সরানো যায়। কিন্তু এতোকিছুর প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও আমি রাইসাকে কিছুই বুঝতে দেইনি। কারণ দোষটাতো মূলত আমারই, আমি যদি স্ত্রীর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাবা মা'কে ছোট না করতাম তাহলে আজ আমি নিজের সাথে এই কলঙ্ক বয়ে বেড়াতাম না।


দীর্ঘ ছয় মাস পর মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। এর আগে এসেছিলাম শুধুমাত্র বাবার মৃত্যুর একবছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মিলাদের জন্য। সত্যি বলতে রাইসাকে অতিরিক্ত বিশ্বাসের দরুন ওর কথায় মায়ের প্রতি আমার মনে এতোটাই প্রকট ঘৃণা জন্মেছিল যে বাবার মিলাদের দিনের রাতটুকু থেকে পরদিনই কর্মস্থলে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে মায়ের সাথে করা এমন অবিচার একজন নিকৃষ্ট সন্তান বৈকি কেউ করতে পারে না।

মা আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন না বরং নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের বাসার কাজের মেয়ে ময়না আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো, 

"ভাইজান, আপনে এতোদিন পর বাড়িতে আইছেন! আহেন ঘরে আহেন! কিন্তু ভাবি কই ভাবিরেতো দেখতাছি না।"

আমি খানিকটা মুচকি হেসে বললাম,

"তোর ভাবির এবাড়িতে আসতে ভালো লাগেনা তাই আসেনি। ওসব বাদ দে, চল ভিতরে চল আর এই তরকারী আর মাছগুলো ভিতরে নিয়ে যা।"

আমার কথা শুনে মুহূর্তেই ময়নার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি চুপসে গেল। কোনো কিছু না বলেই সে বাজারগুলো ভিতরে নিয়ে চলে গেল।


বসে আছি মায়ের মুখোমুখি, মুখে কোনো কথা নেই আমার। কিছু বলতে গেলেও যেন অদৃশ্য কোনো এক শক্তি আমাকে কথা বলতে বাধা দিচ্ছে। কিভাবেই বা এমন পাপী এক সন্তান তার মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবে?

আমার ইতঃস্তত ভঙ্গিমা দেখে মা বলে উঠলেন,

"কিছু বলার থাকলে বল, আমার অনেক কাজ পরে আছে।"

মায়ের এমন কথায় আমার বুকের মাঝে কিছুটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। নীরবতা ঠেলে বললাম,

"মা আমি আসলে আমার বউকে চিনতে পারিনি। ও যে এরকম অভিনয় করে তোমার আর আমার মধ্যে একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে তা আমার ভাবনাতেই ছিল না। আজ আমি বুঝতে পেরেছি। এসবের পিছনে একমাত্র হাত আমার শাশুড়ির। ঐ মহিলার জন্যই এতোকিছু হয়েছে।"

আমার কথা শুনে মা ভাঙ্গা গলায় বললেন,

"ভেবেছিলাম তুই একমাত্র ছেলে হিসেবে তোকে বিয়ে করিয়ে বউসহ ঘরে রাখবো। সে আশা হয়তো আল্লাহ পূরণ করেননি ঠিকই তবে এখন আমি একা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার সাথে এখন আর কাউকে না থাকলেও চলবে। যেই ছেলে বউয়ের কথায় মা'কে ভুল বুঝে সেই ছেলের সান্নিধ্যের দরকার নেই আমার।"

এই বলেই মা শাড়ির আঁচল খানা দিয়ে নিজের চোখ দুটো ঢেকে ফেললেন। সন্তানের প্রতি কতটা অভিমান জমলে একজন মা এমন কথা বলতে পারেন সেটা এই মুহূর্তে আমি আমার মা'কে দেখেই অনুধাবন করতে পারছি।


রাইসা দরজাটা খুলেই আমার সাথে মা'কে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। হয়তো ভাবতে পারেনি এমুহূর্তে মা'কে নিয়ে ওর সামনে উপস্থিত হবো। ওর কৌতূহলের রেশ কাটাতে আমি নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠলাম,

"আজ থেকে মা আমাদের সাথে থাকবে। তুমি পশ্চিম দিকের রুমটা গুছিয়ে ফেলো। মা! ভিতরে আসো!"

এই বলেই রাইসাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মা'কে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।


ইদানিং রাইসার মাঝে আমার প্রতি আগের কেয়ারিং ভাবটা একদমই দেখতে পারছি না উল্টো সময় পেলেই ভিন্ন কথায় আমাকে মায়ের দোষত্রুটি বলার চেষ্টা করে। বিয়ের পর ওর এমন কথাবার্তার মর্ম বুঝতে না পারলেও এখন বেশ ভালোভাবে এবং স্পষ্টতই আমি সবকিছু বুঝতে পারি। কিন্তু তবুও আমি আমার স্ত্রীকে এসব কিছু কখনোই বুঝতে দেইনি। কারণ নারী জাতি আর কিছুতে অভিজ্ঞতালব্ধ না হলেও পুরুষ জাতিকে প্যাঁচে ফেলতে বেশ অভিজ্ঞ। আর শাশুড়ির কল্যাণে আমার স্ত্রীর মাঝে যে সেই অভিজ্ঞতা টুকু আছে সেটা আমি এখন বেশ ভালোভাবেই আঁচ করতে পারছি।


আজ হঠাৎই আমার স্ত্রীকে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,

"তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নাও, আজ আমরা শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাবো।"

আমার কথায় সে কিছুটা অবাক হলো কেননা বিবাহ পরবর্তী জীবনে এই প্রথম আমি শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছি। এর আগে আমার স্ত্রী হাজার বার বলেও আমাকে তার বাপের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারতো না, কেননা একান্ত কোনো প্রয়োজন ছাড়া কখনোই আমি শ্বশুর বাড়ির ধুলো পায়ে লাগাইনি।


বসে আছি সোফায় আমার শ্বশুরের মুখোমুখি। আমার মা'ও আমাদের সাথে এবাড়িতে আসাতে আমার শাশুড়ি যে খুশি হননি সেটা তার গম্ভীর মুখখানা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। নীরবতা ঠেলে আমার শ্বশুর আব্বা বেশ উৎসুক কন্ঠে বলে উঠলেন,

"তা বাবা কখনো তো তোমাকে জোর করেও আমাদের বাড়িতে আনা যায় না তাহলে আজ কি মনে করে এলে?"

আমি কিছুটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললাম,

"আপনিতো জানেনই আমি কোনো প্রয়োজনীয় কাজ ব্যতীত এখানে আসি না, সুতরাং আজকের কাজটা অন্যান্য কাজের চেয়ে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো এই কাজের জন্য কোনো পুরুষ শ্বশুর বাড়িতে আসে কিনা সন্দেহ তবে আমি আজ আসতে অনেকটা বাধ্যই হলাম।"

আমার অদ্ভুত কথা শুনে শ্বশুর মশাই কিঞ্চিত অবাক হয়ে বললেন,

"কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ, বাবা"

"জ্বী আমি আপনার মেয়েকে রেখে যেতে এসেছি। ভাববেন না যে দুই একদিনের জন্য, সারাজীবনের জন্যই রেখে যাবো। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমি আপনার মেয়ের সাথে আর সংসার করতে ইচ্ছুক নই।"

কথাগুলো বেশ জোরে বলাতে রান্নাঘরে আমার শাশুড়ির নিস্তব্ধতা দেখে বুঝতে পারলাম তিনিও পুরো কথাগুলোই শুনেছেন। শ্বশুর আব্বা কৌতূহল মুখে বললেন,

"হঠাৎ এমন কথা বলছো কেন? আমার মেয়ে কি তোমার সাথে কোনো খারাপ কিছু করেছে?"

"পৃথিবীতে যদি কোনো নিকৃষ্ট মা থেকে থাকে তবে সেই কাতারে আমার শাশুড়ি আম্মা সবার উপরেই থাকবেন। মূলত আপনার স্ত্রী অর্থাৎ আমার শাশুড়ির জন্যই আমি আপনার মেয়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে যাচ্ছি। যেই মা তার মেয়েকে শিক্ষা দেয় কিভাবে অন্য মায়ের হৃদয় থেকে তার ছেলেকে কেড়ে এনে সেই ছেলের কাছে ঐ মা'কে খারাপ বানাতে হয় সেই নারীর মেয়ের সাথে অন্ততপক্ষে আমি সংসার করতে ইচ্ছুক নই।"

এই বলেই মোবাইলটা বের করে রাইসা এবং আমার শাশুড়ির বেশ কিছু কল রেকর্ড শুনালাম আমার শ্বশুরকে। তিনি রেকর্ডিংগুলো শুনে মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। পাশে বসে থাকা আমার মা নিজেও আমার এমন কান্ডে অবাক চিত্তে স্বস্থানে বসে আছেন।

কোনো এক সূত্রে জানতে পেরেছিলাম আমার শাশুড়ি নাকি শ্বশুরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর তার শ্বশুর বাড়িতে এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হননি উল্টো শ্বশুর মশাইয়ের সরলতাকে পুঁজি করে তাকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো তিনিও চেয়েছিলেন তার মতোই তার মেয়েও স্বামীকে বশে এনে আলাদা হয়ে যাক। 


এইমুহূর্তে আমি আর আমার মা নিজেদের বাড়ির সোফায় বসে আছি। শ্বশুর বাড়ি থেকে আশার পর মা কোনোভাবেই নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। কারণ তিনি কখনোই চাইবেন না তার কারণে তার ছেলের সাথে পুত্রবধূর বিচ্ছেদ ঘটুক।

আমি জানি রাইসাকে বাড়িতে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত আমার মা এক লোকমা ভাতও মুখে নিবে না তবে এই ধরণের শাশুড়ি আর মেয়েদের যদি একটি শিক্ষা দেওয়া না হয় এবং সমাজের মাঝে তাদের মুখোশগুলো উন্মোচন করা না হয় তবে তাদের কারণে হাজারো যুবক মাতৃ ছায়াতল থেকে বিচ্যুত হবে এবং মায়েরা হারাবে নিজের প্রতি সন্তানের সম্মান প্রদর্শনের প্রতিচ্ছবি। মাঝে মাঝে পুরুষদেরও এমন কিছু চাল খাটাতে হয় নয়তো স্ত্রীরা চড়ে বসবে সিংহাসনে সুউচ্চ পর্যায়ে যেটা কখনোই কাম্য নয়।


অদ্ভুত চাল

Misk Al Maruf


মন‌ ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন গল্প পড়ুন।

Previous Post Next Post