গল্পের নাম: লিটনের না বলা গল্প
টাকা ছাড়া পুরুষ মূল্যহীন
লিটন, বয়স মাত্র ২৫। একটা বয়স যেখানে স্বপ্ন দেখার কথা, ভবিষ্যতের রঙিন ছবিতে নিজেকে কল্পনা করার কথা—সেই বয়সেই লিটন শুধু একটা শব্দের ভারে ভেঙে পড়ছে প্রতিদিন: টাকা।
ছোট্ট একটা শহরে বেড়ে উঠেছে লিটন। বাবা একজন রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, মা একজন সাধারণ গৃহিণী। সংসার চলে টেনেটুনে। ভালো খাওয়া তো দূরে থাক, ঈদের নতুন জামা পর্যন্ত কখনও একাধিক কিনতে পারেনি লিটন। তবু মনের ভেতর একটা শান্তি ছিল, কারণ বাবা-মায়ের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম।
বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে পড়েছে, একসঙ্গে স্বপ্ন দেখেছে—“দেশের বাইরে যাবো, অনেক টাকা কামাবো, মায়ের জন্য সোনার চুড়ি কিনবো।”
তবে সময় বদলালো।
বন্ধু রাকিব গেল মালয়েশিয়া, জামান গেল দুবাই, রিফাত গেল ইতালি।
লিটন? সে যায়নি। যাওয়ার টাকা ছিল না। ৩ লক্ষ টাকার ভিসা বানানোর সামর্থ্যও ছিল না তার।
দিন যায়, সময় যায়—বন্ধুরা দেশে ফিরে আসে মোটা মোটা চেইন গলায়, নতুন ফোন হাতে।
কারও হাত ভরা সোনা, কারও পকেটে নতুন গাড়ির চাবি।
আর লিটন? এখনো প্রতিদিন সকালে পুরনো স্যান্ডেল পায়ে চাকরির খোঁজে বের হয়, সন্ধ্যাবেলায় খালি হাতে বাড়ি ফেরে।
একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“লিটন, বাবার ওষুধ শেষ। ১৫০০ টাকা দরকার।”
লিটনের হাতে ছিল মাত্র ২০০ টাকা।
বন্ধুকে ফোন দিলো—
“ভাই, একটু হেল্প কর, জরুরি।”
—“দোস্ত, একটু বাহিরে আয় না, আড্ডা মারব। উত্তর এলো__ এখন একটু ব্যস্ত।”
লিটনের চোখে পানি এসে গেল। সে বুঝল, সম্পর্ক এখন আর রক্তের বন্ধনে নয়, টাকার সুতায় ঝুলে আছে।
কিছুদিন পর লিটনের বিয়ে ঠিক হলো। পাত্রী ভালো, ভদ্র। কিন্তু বিয়ের আগেই মেয়ের মা বলে দিলো—
“জামাই কি করে? মাসে কত আয়?”
“ভবিষ্যতে বিদেশ যাবে তো?”
“মেয়ে যেন কষ্ট না পায়!”
লিটনের বুকটা কেঁপে ওঠে। সে ভাবে—ভালোবাসা বুঝি এখন মাসিক ইনকামের ওপর নির্ভর করে?
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গেল লিটন। উঠানে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ফিসফিস করে বলছে—
“এই ছেলেটা কি চাকরি করে? মাসে কতো দেয়? এই মেয়ে কি সুখে থাকবে?”
লিটন সব শুনে চুপ করে থাকে। কারণ তার দেওয়ার মতো উত্তর নেই, শুধু নীরবতা আছে।
একদিন রাতে নিজের রুমে বসে ডায়েরি খুলে লিখে—
> “আজ বুঝলাম,
বাবা টাকা না থাকলে ছেলের মুখের দিকে তাকায় না,
মা টাকা না থাকলে মমতা লুকিয়ে রাখে,
ভাই-বোন টাকা ছাড়া সম্পর্ক ধরে না,
বন্ধু বান্ধব কেবল দামি জিনিসে মুগ্ধ হয়,
শ্বশুর-শাশুড়ি জামাইয়ের আয় দেখে সম্মান দেয়,
পৃথিবীতে এখন আর মন দেখে না, দেখে মুঠোফোনের ব্যালেন্স।
টাকাই এখন মানুষ, আর মানুষ এখন শুধু প্রয়োজন।”
লিটন জানে, তার কোনো কাঁধে মাথা রাখার মানুষ নেই।
সে জানে, এই সমাজ তাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে তার সম্ভবনা।
সম্ভবনা একদিন অনেক টাকা কামানোর, গরিব থেকে বড়লোক হয়ে ওঠার।
তবু সে হারে না।
প্রতিদিন ভোরে উঠে আবার চাকরির খোঁজে বের হয়। হয়তো একদিন সে সত্যিই টাকা কামাবে, হয়তো একদিন তার জন্যও মানুষ সম্মান দেখাবে।
কিন্তু সে জানে—সেই সম্মানে আর কোনো গরম থাকবে না, থাকবে না ভালোবাসা।
শুধু থাকবে একটা সত্য:
এই সমাজে মানুষ টাকায় তৈরি, আর যার টাকা নেই, তার কেবল গল্প আছে।