গল্পের নাম: লিটন
(একটি কষ্টদায়ক গল্প, টাকার বাস্তবতা নিয়ে)
টাকা ছাড়া জীবন
লিটনের জন্ম হয়েছিল এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন একজন সরকারি অফিসের কেরানি—ছোট চাকরি, অল্প বেতন। মায়ের হাতে সংসারের রাশ। অভাব ছিল, কিন্তু লিটন ছোটবেলায় কখনও বুঝতে দেয়নি কষ্ট তাকে ছুঁয়ে গেছে।
বাবা প্রতিদিন খুব সকালে বের হতেন, রাত করে ফিরতেন। মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও ছেলের মুখ দেখলেই হাসি ফুটে উঠত। মা বাড়ির কাজ সামলাতেন, মাঝে মাঝে লোকের বাসায় সেলাইয়ের কাজ করতেন, যেন লিটনের পড়াশোনা বন্ধ না হয়।
লিটন ছিল মেধাবী, স্বপ্নবাজ। তার চোখে একটাই লক্ষ্য—“একদিন আমি বড় হবো, টাকার অভাব থাকবে না আর!”
ছোটবেলা থেকে সে দেখে এসেছে—
বাবা হাটে গিয়ে দামাদামি করে মাছ কেনেন,
মা নতুন শাড়ি চান না, কারণ ছেলে যেন টিউশনি করতে পারে,
ভাই-বোন আত্মীয়দের বাড়ি যেতে লজ্জা পায়, কারণ ‘আমাদের কিছু নেই’।
কিন্তু যখন বড় হয়ে পড়াশোনা শেষ করল, চাকরির বাজারে ঢুকল, তখনই বুঝল—এই সমাজে মেধার চেয়ে বড় হচ্ছে টাকা।
প্রথম ধাক্কা খায় যখন বাবা অসুস্থ হয়। ডাক্তার বলল,
“ভালো হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে, খরচ হবে প্রায় দেড় লাখ।”
লিটন কোথাও টাকা পেল না। বন্ধুদের কাছে গেল—
“দোস্ত, তোকে তো চিনি, কিন্তু এখন টানাটানি।”
পরিবারের কিছু আত্মীয় ছিল—যাদের বাড়িতে খেয়ে, কেঁদে দিন কেটেছে ছোটবেলায়। তারাও বলল,
“লিটন, বুঝতেই তো পারছিস, সময় খারাপ, এখন দিতে পারব না।”
বাবা শেষ পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। সেই দিন থেকেই লিটনের ভিতর কিছু ভেঙে গেল।
সে ঠিক করল—জীবনে কিছু না হোক, টাকা কামাতে হবে। অনেক টাকা।
দুই বছর পর, লিটন একটি কোম্পানিতে চাকরি পেল। কঠোর পরিশ্রম করত, সময়-অসময়ে কাজ করত। তিন বছর পর সেই ছোট অফিসার ছেলেটা আজ লাখ টাকা ইনকাম করে। কিন্তু জীবনটা ঠিক যেন উল্টো হয়ে গেল।
একদিন মা বললেন,
“বাবা, বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাবি? ঘরের চালের অবস্থা ভালো না।”
ভাই বলল,
“তোর এখন আয় ভালো, আমাকে একটা বাইক কিনে দে।”
বোনের স্বামী বলল,
“তোর মতো জামাই পেয়ে তোর বোন তো ভাগ্যবতী, এবার একটা স্মার্টফোন কিনে দে না ভাই।”
বন্ধুরা এখন কেবল ফোন করে যখন দরকার—
“দোস্ত, আমার একটা ইমার্জেন্সি আছে, ২০ হাজার দে।”
“তোর লাইফ সেট ভাই, আমার কিছু হেল্প কর।”
এমনকি বিয়ের প্রস্তাবে মেয়ের মা প্রথমে বলেছিল,
“ছেলে কি করে?”
“কত ইনকাম?”
“ফ্ল্যাট আছে?”
“গাড়ি আছে?”
সব উত্তর যখন হ্যাঁ হল, তখন রাজি হল। মেয়েটিও সুন্দরী, শিক্ষিতা, কিন্তু একটা কথা চিরকাল লিটনের মনে গেঁথে গেল—
“তুমি না অনেক কামাও, তাই আম্মু রাজি হয়েছে।”
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি গেল। সেখানে এক আত্মীয় ফিসফিস করে বলল,
“জামাই মাসে কত কামায়?”
“এইটা আমাদের মেয়ে ঠিক সামলাবে তো?”
লিটন তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে হাসল। সে হেসেছিল, কারণ সে জানে—এই হাসির আড়ালে কষ্ট লুকানো।
রাতে ডায়েরি খুলে সে লিখল—
> “বাবা বলেছিলেন, ভালো মানুষ হো।
মা বলেছিলেন, আদর্শ বান।
কিন্তু কেউ বলেনি—এই পৃথিবীতে টাকা না থাকলে তোর কোনো মূল্য থাকবে না।
ভাই-বোন টাকা ছাড়া সম্পর্ক রাখে না,
বন্ধু দাম দেয় টাকার গন্ধে,
শ্বশুরবাড়ি জামাই চায়, মন নয়—বেতন দেখে।
এই সমাজে মানুষ নয়, টাকাই সম্পর্ক গড়ে।
আমি শুধু লিটন না, আমি হাজারো লিটনের প্রতিচ্ছবি।”
---
গল্পের উদ্দেশ্য কিছু কথা
এই গল্পটা শুধু একজন লিটনের নয়—এটা আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। এখানে টাকা ছাড়া কারও ভালোবাসা নেই, সম্মান নেই, সম্পর্ক নেই।
একটা সময় মানুষ মানুষকে ভালোবাসত—এখন মানুষ টাকাকে ভালোবাসে।